ডেঙ্গু প্রতি বছরই দুশ্চিন্তার কারণ হলেও এবছর একটু বেশিই ভয়ংকর রূপে দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা গত ২৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। ২০২২ সালের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড এর মধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে চলতি বছর। প্রশ্ন হলো- ডেঙ্গু থেকে আমাদের মুক্তি কীভাবে? করোনা মহামারিতেই আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে অবহেলা স্পষ্ট ছিল। তা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে এর সমাধান কোথায়? এর কার্যকরী সমাধান সম্ভব টিকা প্রয়োগে। শরীরেই যদি প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে তাহলে রোগ হবে না। পৃথিবীজুড়েই অতি ক্ষুদ্র; কিন্তু ভয়ংকর একটি প্রজাতির প্রাণী হলো মশা। প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় এই প্রাণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে যে, চলতি বছরই আক্রান্ত রোগীর হিসেবে ডেঙ্গু রেকর্ড করতে যাচ্ছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বিশ্বে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু।
তবে আমাদের দেশে একটু বেশিই বিস্তার করেছে এডিস মশা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিভির খবরে অপেক্ষা করতে হয় আজ কতজন আক্রান্ত ও মৃত্যু ঘটেছে। প্রতিদিন মানুষ মরছে ডেঙ্গুতে। ডব্লিউএইচও জানায়, বিশ্বের বৃষ্টিবহুল ও উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে এই রোগ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পরছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কন্ট্রোল অব নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজ বিভাগের বিশেষজ্ঞ ড. রমন ভেলাইউধান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ২২ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর হার বেড়েছে আটগুণ এবং চলতি বছর তা আরো বাড়তে পারে। তিনি আরো বলেন, আমাদের হাতে থাকা তথ্য অনুসারে বর্তমানে বিশ্বের প্রতি বছর বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পেরু এবং তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউরোপের উত্তর ও পশ্চিম দিকে এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশার বিস্তার ঘটছে। এই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের বাহক। অর্থাৎ বিশ্ব উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়েই মশার উপদ্রব এবং বংশ বিস্তার বাড়ছে যা উদ্বেগজনক। এই বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে মশা নিধনের পাশাপাশি জোর দিতে হবে টিকায়। আমরা দেখেছি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকরী ছিল এর ভ্যাকসিন। যে দেশগুলো যত দ্রুত করোনার টিকা জনগণের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছিল, সেই দেশ তত দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরতে পেরেছিল। আমাদের দেশও ছিল দ্রুত করোনার টিকা দেওয়ার দেশ।
যেহেতু এখন ডেঙ্গু শুধু একটি ঋতুভিত্তিক সমস্যা না বা এর আক্রান্ত এবং মৃত্যু বাড়ছে সেহেতু টিকাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। যদিও এটি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এটাই সবচেয়ে কার্যকরী। এর মধ্যেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী অগ্রগতি হয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি টিকা ‘কিউডেঙ্গা’র অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য গত ২ অক্টোবর এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়া আগেই এই টিকা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা। দুই ডোজের এই টিকা শুধুমাত্র ছয় থেকে ১৬ বছর বয়সিদের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর আগে সানোফি-এ্যাভেন্টিজের তৈরি ডেঙ্গু টিকা ‘ডেঙ্গাভেস্কিয়া’র অনুমোদন দিয়েছে কয়েকটি দেশ।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের সফল পরীক্ষা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা এই টিকার সফল ট্রায়াল (পরীক্ষা) করেছেন। বাংলাদেশে আইসিডিডিআরবির সহায়তায় ‘টিভি০০৫’ নামে একটি ডেঙ্গু টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ। এই পরীক্ষার প্রথম দুই ধাপে তারা সফলতা পেয়েছে। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা সফল হলে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। গণমাধ্যম থেকে এই তথ্য জানা গেছে। সুতরাং আমরাও ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। এটাই সমাধান। কিন্তু যতদিন টিকা না আসে, ততদিন তো আমাদের টিকতে হবে। মশা নিধন, বংশ বিস্তার রোধ এবং সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। টিকা পেলেও এসব অব্যাহত রাখতে হবে।