ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে

রেজাউল করিম খোকন
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায় ২০০ কোটি মানুষের বসবাস। অথচ এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। এসব দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাব আছে। এই দেশগুলোর রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় উপার্জনকারীদের অধিকাংশই আবার অদক্ষ। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক বাধার পাশাপাশি অশুল্ক বাধাও আছে। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের মাত্র আট শতাংশ হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। শুধু ঔপনিবেশিক আমল নয়, দেশগুলোর সঙ্গে হাজার বছরের সম্পর্ক বাংলাদেশের। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে নৌ, সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার কমিয়ে ১৮ শতাংশে নিয়ে আসতে পেরেছে। আমরা অবকাঠামো উন্নয়ন করছি। আমরা ভারত, নেপাল ও ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে অবাধে চলাচল করতে আগ্রহী। দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ বাণিজ্যই হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় এবং অঞ্চল হিসেবে ‘দক্ষিণ এশিয়া’ এখনো শক্তিশালী কোনো জায়গা নয়। অথচ একে শক্তিশালী করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ-ভারতের অবকাঠামো উন্নয়ন যতটুকু হয়েছে, তা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর জোর দিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংযোগ কম। এ জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা ও প্রতিশ্রুতি দরকার। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধার দিক থেকে আঞ্চলিক অখণ্ডতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে মোটামুটি মিল আছে। এগুলো হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা। কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ খুবই কম। গভীর গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাগুলো মোকাবিলায় ঐকমত্য দরকার। আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়ে অতীতে বহুবার আলোচনা হয়েছে। এখন নতুন বাস্তবতা। ফলে নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের মাত্র পাঁচ শতাংশ হয় নিজেদের মধ্যে। তাই বাণিজ্য বাড়াতে ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হওয়া দরকার। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদারে দরকার শক্তিশালী গণতন্ত্র। আঞ্চলিক সংঘাত আছে। আছে জলবায়ু পরিবর্তন। এসব সমস্যা দূর হওয়া উচিত। আর এ জন্য দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একই ভৌগোলিক রেখায় অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে একক মুদ্রা (কমন কারেন্সি) প্রচলনের মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এখনও তৈরি হয়নি। এই অবস্থায় দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে হবে। কমাতে হবে ব্যবসার খরচ। পাশাপাশি নিয়মিত পারস্পরিক পরামর্শ চালু করতে হবে। একটি অঞ্চলের জন্য একক মুদ্রা প্রচলন করতে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। এর মধ্যে অর্থের অবাধ চলাচল, সীমান্ত অতিক্রম করার স্বাধীনতা, ঝুঁকি সহনশীলতা, পারস্পরিক আস্থা, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন ইত্যাদি। একই ভৌগোলিক সীমায় অবস্থানের পরও প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা ভিন্ন। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতের মুদ্রারুপি বেশ অস্থিতিশীল। তাই কোনো ব্যাংক রুপি কিনে রাখলে তাতে ঝুঁকি থাকতে পারে। এ ছাড়া সার্বভৌমত্ব ইস্যু বিবেচনা করলে দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা চালুর প্রেক্ষাপট এখনো তৈরি হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। একক মুদ্রা বা কোনো দেশের মুদ্রাকে নীতিনির্ধারক ধরে চালকের আসনে বসানো যুক্তিযুক্ত হবে না। এখন একক মুদ্রা ব্যবহারের মতো ইউনিয়ন গড়ে তোলার সময়ও হয়নি। টাকা-রুপি ও চীনা মুদ্রায় লেনদেন চালু হলেও তাতে সাড়া মিলছে না। ভারতের সঙ্গে প্রতি মাসে বাংলাদেশ ও চীনের বড় আকারের বাণিজ্য ঘাটতি আছে। এ জন্য মুদ্রা অদলবদলের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় একক মুদ্রা প্রচলনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ মিলে ‘রুপা’ নামের মুদ্রার প্রচলন করতে চেয়েছিল। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। এখন যে পরিমাণ রুপি আয় আছে, রুপিতে শুধু সে পরিমাণ আমদানি করা হচ্ছে। রাশিয়া, আফগানিস্তান ও চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের নিজস্ব মুদ্রার লেনদেন হয়। একক মুদ্রার আশা না ছেড়ে আমাদের সবার বিকল্প খোঁজ করা উচিত। যাতে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে। চ্যালেঞ্জ থাকলেও বসে না থেকে স্বল্প পরিসরে নতুন উদ্যোগ হিসেবে শুরুর চিন্তা করা উচিত। বাণিজ্যকে সামনে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য স্বল্প পরিসরে হলেও একক মুদ্রার প্রচলন হতে পারে। এর চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে দেশগুলোর আমদানি-রপ্তানি ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া একই ধরনের হওয়া। প্রতিটি দেশের পণ্য শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ডকুমেন্ট বা কাগুজে প্রমাণাদির সংখ্যাও ভিন্ন। এতে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় বেশি। একটি নির্দিষ্ট ছকে সবাই শুল্কায়ন করলে তা নিয়ে আপত্তি উঠলেও নিষ্পত্তি করা সহজ হয়। এটি সব দেশ চাইলেই পারে। ডলারের বিকল্প লেনদেন চালু হলে খরচ কমবে। ধীরে ধীরে বৈশ্বিক বাজারে ডলারের লেনদেন কমছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে লেনদেনের নয় শতাংশ ছিল ডলারবহির্ভূত, যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবসা বাড়াতে খরচ কমাতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসার স্বার্থে নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। ডলারকে দুর্বল করে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রার মর্যাদা থেকে তাকে নামিয়ে আনার চেষ্টাও ব্রিকস দেশগুলো করে যাচ্ছে। চীনা আধিপত্যের অধীনে থাকা ব্রিকস নামের এই গ্রুপ মার্কিন স্বার্থবিরোধী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করে থাকে বলে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে।

কেউ কেউ বলেন, ভারত কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে না? তাদের সঙ্গে ভিসা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যু আছে। রুপি-টাকা লেনদেন চালু হয়েছে, কিন্তু লেনদেন হচ্ছে না। এই লেনদেন চালু করতে হলে ভারতকে বড় অঙ্কের লাইন অব ক্রেডিট দিতে হবে। বড় ধরনের ঝুঁকি সামলাতে ভারতীয় ও বাংলাদেশি মুদ্রার অদলবদল (সোয়াপ) করতে হবে। এসব উদ্যোগে ভারতকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি উভয় দেশকে করনীতি পরিবর্তন করতে হবে। দুই দেশ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রানীতি নিয়ে প্রতি ৩ মাস অন্তর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে সভা করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত