ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধে ব্যবস্থা নিন

মীর ইমরান আলী, কলাম লেখক
কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধে ব্যবস্থা নিন

দেশজুড়ে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে উঠতি কিশোরদের গ্যাং কালচার। এই কালচারের সাথে জড়িয়ে আছে স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের মধ্যকার সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা, মাদক, নারী নির্যাতন এমনকি খুন খারাবির প্রবণতা। এছাড়া টিকটক, লাইকিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে অপরাধ করছে তারা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। আদনান হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র অনিককে। অন্যদিকে রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোতেও বেরিয়ে আসে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ এবং তাদের সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ঙ্কর সব চিত্র। এ সকল গ্যাং সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকাতেই গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান মিলেছে অন্তত ৫০টি। এইসব কাজ করছিল তাদের সদস্যদের সবার বয়সই ১৪ থেকে ১৮ এর মধ্যে। তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। বিভিন্ন জেলা শহরের কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি।

এদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সাথে যুক্ত। আর অভাবের কারণে এদের অধিকাংশই নানারকম অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী ৪৪ শতাংশ পথশিশু মাদক চালানের সঙ্গে জড়িত, ৩৫ শতাংশ জড়িত পিকেটিংযের সাথে, ১২ শতাংশ জড়িত ছিনতাইয়ের সাথে, ১১ শতাংশ মানব পাচার এবং ২১ শতাংশ অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে অনেককে আগ্নেয়াস্ত্র বহন, হত্যা, মাদক চালান, ডাকাতি, চুরি, রাজনৈতিক সহিংসতা, যৌন হয়রানির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত আটক করেছে। অথচ অপরাধের সাথে শিশু কিশোরদের ক্রমশ জড়িয়ে পড়ার হার বাড়ছে বলে ২০০৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেই উদ্যোগী হয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সেই গবেষণা অনুযায়ী শিশু অপরাধীদের গড় বয়স ছিল ১৪ দশমিক ৯ বছর। মূলত পরিবারের আর্থিক অভাব, প্রাচুর্য, শিক্ষার অভাব, শাসনহীনতা, অভিভাবকের উদাসীনতা, মূল্যবোধের সংকট, পরিবারের ভেতরে অপরাধীর বা অপরাধের উপস্থিতি শিশুকে বিপদের মুখে এনে দাঁড় করায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবরাই শিশু কিশোরদের অপরাধ জগতের দিকে টেনে নিলেও, দরিদ্র শিশুদের খাবার ও আশ্রয়ের কথা বলে অপরাধীরা এই জগতে টেনে আনে। এছাড়া সমাজের মধ্যে বিরাজমান ফারাকও শিশুকে অপরাধী হতে পথ দেখায়। এই শিশুদের শতকরা ৮০ জনই জানে যে তারা অপরাধ করছে। তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে, অভাবের কারণেই তারা অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কিশোরীরাই সংখ্যায় বেশি। কিশোর গ্যাং গোষ্ঠীগুলো তৈরি হলো কেন? কেনই বা তারা এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোরদের মধ্য অ্যাডভেঞ্চার ফিলিং বা হিরোইজম ভাব বেশি দেখা যায়। কিশোর বয়সে বেড়ে উঠার পরিবেশ তাকে অপরাধী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। কিশোর বয়সে ইতিবাচক চর্চার দিকে না গিয়ে, নেতিবাচক চর্চার দিকে চলে যায়। আবার যখন তারা দেখে যে, অপরাধ যারা করছে তারা সমাজে বেশি লাভবান হচ্ছে, সেটা কিশোররা অনুসরণ করে। তাদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। লক্ষণীয় বিষয়, আমাদের সমাজে নানা অসংগতি রয়েছে। নিজেদের সাংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ও সময়ের অনেক কিশোর, তাদের আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে। অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন লোমহর্ষক ও ভিনদেশি সংস্কৃতি ইচ্ছা মতো তাদের আয়ত্তে চলে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যবহার করার কারনে তাদের মধ্য গ্যাং কালচার গড়ে উঠার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। গত বছর ঢাকার উত্তরায় ‘অপু ভাই’ নামে খ্যাত টিকটক ভিডিও নির্মাতা একটি রাস্তা অবরোধ করে ৭০ থেকে ৮০ জন কিশোর মিলে টিকটক ভিডিও তৈরি করছিল। সেই মুহূর্তে রবিন নামক একজন প্রকৌশলী গাড়ি নিয়ে রাস্তা পার হতে গেলে অপু ভাইসহ তার দল মিলে মারপিট করে উক্ত ব্যক্তির মাথা ফাটিয়ে দেয়। কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি। কারণ, তাদের ছেলেমেয়ে কার সাথে মিশছে, কীভাবে বড় হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেন না, পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে। কিশোরদের সমাজের ইতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।

তাই এর জন্য সমাজ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রাখা চাই। আগামী প্রজন্মের কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ এবং কলুষমুক্ত ও সুস্থ সমাজ গঠনে এখন থেকেই এই বিষয়ে সবাইকে বিশেষ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎপর এবং যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে। তাহলেই গ্যাং কালচারের এই বিপথগামী তরুণদের অপরাধমুক্ত রাখা সম্ভবপর হবে এবং আগামী প্রজন্ম রক্ষা পাবে এক অসুস্থ সমাজ থেকে।

জীবনের অতি মূল্যবান অংশের নাম তারুণ্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার, উদ্যম ও গঠনের এ এক সতেজ অধ্যায়। আর তাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ-সমাজ। এরাই তো নতুন সূর্য- সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার। এই সূর্য ক্ষয় ও অবক্ষয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়ার মানে, সমাজের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাওয়া। কাজেই আমাদের কিশোর-তরুণদের অবক্ষয়ের রাহুগ্রাসে পতিত হওয়া থেকে অবশ্যই ফেরাতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত