আটকে গেল একক ভর্তি পরীক্ষা

শিক্ষার্থীদের কল্যাণে দূর হোক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একবার পরীক্ষায় বসলেই থাকবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। কমবে ভোগান্তি, খরচ ও দীর্ঘসূত্রতা। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অভিপ্রায়ে এমন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট হলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তৈরি করা খসড়া অধ্যাদেশের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বাধ্য হয়ে ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’ চালুর চেষ্টার ইতি টানল ইউজিসি। ফলে সাড়ে ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে এবারো ভোগান্তি সঙ্গী করে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ছুটতে হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, একক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি আটকে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’। এ প্রক্রিয়া চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ হারাবে মন্ত্রণালয়। আর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে ইউজিসির। এ কারণে অধ্যাদেশ জারির বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো ইউজিসিকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গত ৩১ অক্টোবর ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৩’-এর খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ইউজিসি। একমাসেও সেটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। পাঠানো হয়নি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়েও। এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সেদিনই একক ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু ইউসুফ মিয়ার অভিমত হচ্ছে এটা নিয়ে ইউজিসিকে কেন অধ্যাদেশ জারি করতে হবে? অধ্যাদেশের কী দরকার? এখন কি অধ্যাদেশ জারি করার সময়? তারা তো বাড়াবাড়ি করছেন। অধ্যাদেশ ছাড়া এতদিন ভর্তি করা যায়নি?

গত বছরও তো ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে, এবারো হবে। কীভাবে পরীক্ষা হবে, তা নিয়ে ইউজিসির চেয়ে মন্ত্রণালয় ও সরকারের মাথাব্যথা বেশি। এর একদিন পরই ২৮ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা ‘সম্ভব নয়’ জানিয়ে ইউজিসিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রোখছানা বেগমের সই করা যে চিঠিটি ইউজিসিতে পাঠানো হয়েছে, ইউজিসিকে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা। কিন্তু তা না করে ইউজিসি সরাসরি অধ্যাদেশের খসড়া পাঠিয়েছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশন না থাকা অর্থাৎ, বিলুপ্ত থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা বিবেচনায় অধ্যাদেশ জারি করেন। বর্তমানে দেশে কোনো জরুরি অবস্থা বিদ্যমান নেই। বিধায় এক্ষেত্রে অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামানের অভিমত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও খরচ কমানো যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে এখনো সেটা সম্ভব। বর্তমানে ২২ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি সাধারণ গুচ্ছ আছে। নতুন আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হচ্ছে। সেগুলো ওই গুচ্ছে যুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে ‘কৃষি গুচ্ছ’ রয়েছে। এখন বুয়েটের নেতৃত্বে ‘প্রকৌশল গুচ্ছ’ এবং ঢাবির নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গুচ্ছ হতে পারে। চারটি গুচ্ছে পরীক্ষা হলেও ভোগান্তি অনেকাংশ কমে আসবে। খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ নামে যে কমিটি হবে, তার চেয়ারম্যান হবেন ইউজিসি চেয়ারম্যান। যিনি এরই মধ্যে বিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত। এ পরিপ্রেক্ষিতে তার আরেকটি কর্তৃপক্ষের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা সমীচীন হবে না।

গত বছর তিনটি গুচ্ছ পদ্ধতি ছিল, স্বায়ত্তশাসিত চারটি ও বুয়েট সেসব গুচ্ছে আসেনি। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব জানিয়েছেন, ‘অধ্যাদেশের খসড়াটা দেখে মন্ত্রণালয়ের সবাই অবাক হয়েছেন। এটা যেভাবে করা হয়েছে, তাতে ইউজিসির এককভাবে অনেক ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেখানে মন্ত্রণালয়ের কাউকে রাখার সুযোগ নেই অজুহাতে কাউকে রাখা হয়নি। এটা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভালোভাবে নেননি।’ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মনোভাব সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়ায় ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান জানান, ‘তাদের মনোভাব সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। একক ভর্তি পরীক্ষা করার উদ্যোগ আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় হাতে নিয়েছিলাম। মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি করে খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে জানিয়েছে, এবার অধ্যাদেশ জারি সম্ভব নয়। একক ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে প্রথম থেকেই বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুটা আপত্তি ছিল। তারা ১৯৭৩ সালে প্রণীত অধ্যাদেশের বিষয়টি সামনে এনে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত না হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে একই মত জানিয়ে আসছিল বুয়েটও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এএসএম মাকসুদ কামাল মনে করেন ‘এটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কাজ করছে, তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই চূড়ান্ত। এখানে অন্যের কিছু বলার কেউ না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একজন সদস্য জানান, ‘উনি উপ-উপাচার্য থাকা অবস্থায় যে মতামত দিয়েছিলেন, উপাচার্য হওয়ার পর তা পাল্টে গেছে। এখন ভিন্ন কথা বলছেন, এটা কাম্য নয়। আসলে তারা চাইলে একক ভর্তি পরীক্ষাটা হয়ে যেত। মন্ত্রণালয় এটা ঠেকাতে পারত না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একধারে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে আসছে। তারা অন্যান্য খাতে সাফল্য অর্জন করতে পারলেও কেন যেন শিক্ষা খাতটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পাঠ্যপুস্তক কিংবা শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেসব সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দেয় সেগুলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক কেন যেন বুঝে ঊঠতে পারে না। যা বোধগম্য নয় তা জোর করে শিখিয়ে কার কি লাভ সেটাও পরিষ্কার নয়। বর্তমানে দেশে হরতাল ও অবরোধ চলছে। এই ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি কতদিন চলবে তা কেউ জানে না। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিরাপদে যাওয়ার সুযোগ এখন আর নেই। রাস্তায় বের হলে আগুন সন্ত্রাসের মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে ছাত্রীদের নিয়ে দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কঠিন। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হলে যদি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আর্থিক সুবিধাসহ ভর্তি পরীক্ষা বিড়ম্বনামুক্ত হয়, তাহলে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সমস্যা কোথায়। আবার ইউজিসি কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের যুক্তি তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেটাও বোধগম্য নয়। শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি দুটি প্রতিষ্ঠানই সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। এখনে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষ এমনিতেই কাহিল। তার ওপর শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির ক্ষমতার দ্বন্দ্বের শিকার যদি শিক্ষার্থীরা হয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুভার্গ্যরে আর কিছু থাকে না। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মনে করেন- শিক্ষার্থীদের যাতে কল্যাণ হয়, সেই উদ্যোগ নেয়াই শ্রেয়।