ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মুসলমানের কবরস্থ হওয়ার অধিকার ও অদ্ভুত আইন

সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী
মুসলমানের কবরস্থ হওয়ার অধিকার ও অদ্ভুত আইন

ঢাকার বনানী কবরস্থানে আমার দাদা, দাদি, আব্বা, আম্মা শায়িত। এগুলো কেনা কবর। এতকাল ভেবেছি, অন্তত এই শহরে শেষ নিদ্রায় শায়িত হওয়ার একটা জায়গা আছে। নভেম্বর মাসের ১৯ তারিখ আমার একমাত্র ছোটভাই সোহেল চৌধুরী পরলোকগমন করে। স্বভাবতই তাকে বনানী কবরস্থানে দাদা ও আব্বার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করার সিদ্ধান্ত নিলাম সবাই মিলে। এরপর সহকর্মী তাজুল ইসলাম ছুটে গেলেন বনানী কবরস্থানে। কিন্তু তাকে বলা হলো, দাদা-দাদির কবরে নাতি কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের আর কাউকেই কবর দেওয়া যাবে না। কথাটা শোনার পর শোকের ওই সময়েই হৃদয় বিদ্রোহ করে উঠল। এভাবে কালো আইনের মাধ্যমে আমাদের সমাহিত হওয়ার অধিকারটুকুই কেড়ে নিল কোন পাষ-? ঢাকা শহরে এমনিতেই কবরের জায়গা খুব সীমিত। মুসলমানের এক কবরের ওপর বছরের পর বছর অন্যদের কবরস্থ করার প্রথা চলছে যুগযুগ ধরে। আজ আমাদের ওই ধর্মীয় প্রথা এবং কবরস্থ হওয়ার অধিকারটাও লুণ্ঠিত হলো। এ কেমন নির্মমতা? এ কেমন দানবীয় আচরণ? এই আইন চালু করেছে কারা? শুধু কি ঢাকা সিটি করপোরেশন? নাকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী? কেন এমনটি করা হলো? কার নির্দেশে? কে আমাদের কবরস্থ হওয়ার অধিকার কেড়ে নিল- এসব প্রশ্ন আমি কার কাছে করব? বনানী কবরস্থানে এখন একটা কবরের দাম দেড় কোটি টাকা হলেও কবর দেওয়ার মতো জায়গা নেই। ঢাকার উত্তরা এলাকায় একটি কবরের দাম ২৫ থেকে ৭৫ লাখ টাকা। তাও এটি স্থায়ী নয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর সেখানে অন্য কাউকে সমাহিত করার লক্ষ্যে একই জায়গা আবার বিক্রি করবে কর্তৃপক্ষ। কী ভয়ঙ্কর আইন! জঘন্যতম পৈশাচি প্রথা! এসব করছে কারা এ নষ্ট-দুর্বৃত্ত রাজনীতি আর দুর্গন্ধযুক্ত প্রশাসন এভাবেই ক্রমশ আমাদের অধিকারগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছে, কখনো প্রকাশ্যে আর কখনো গোপনে। আমরা ভুক্তভোগী হওয়ার আগে জানতেও পারছি না অনেক কিছুই। কবরেরও উত্তরাধিকার হয়, এটিরও আইন আছে, এসব জঘন্য কথা ভাবা যায়? কিন্তু এই বাংলাদেশে এসবই ঘটছে। ঘটে চলেছে, আমাদের অজান্তে। আমরা যেহেতু সাধারণ জনগণ, তাই এসবের প্রতিবাদ করার অধিকারটিও নেই আমাদের। সহজ ভাষায় যদি বলি, স্বাধীন এই বাংলাদেশে আমরা সবাই পরাধীন গোলাম। নিঃশর্ত ক্রীতদাস। আমাদের সঙ্গে যেকোনো ধরনের অন্যায় আচরণ চলছে। এসবের প্রতিবাদ করার শক্তি নেই আমাদের কারো। ৩০ লাখ শহীদের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি দেশের মালিক হয়েছি, আমাদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার চাই।

একজন মুসলমানের কবরে অন্য আরেক মুসলমানকে সমাহিত করার বিষয়ে একজন আলেমকে প্রশ্ন করে নিম্নোক্ত উত্তর পেয়েছি- ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে মৃত্যুর হার বেশি, জনবহুল এলাকা অথবা অনেক বেশি লাশ আসে, সে ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও এক বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া থাকে। এক বছর পর কবর খুঁড়ে আবার সেখানে অন্যদের কবরস্থ করা হয়ে থাকে। এটি নির্ভর করে মূলত লাশের চাপের ওপর বা অবস্থানের ওপর। এটা শর্ত নয় যে এত সময় পর্যন্ত রাখতে হবে। এটি নির্ভর করে ব্যবস্থাপনার ওপর। কোথাও কোথাও এক বছর, আবার কোথাও কোথাও দুই বছর পর্যন্ত রাখে। তবে যে জিনিসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, যদি কোনো কবর খোঁড়ার পর কবরে লাশ পাওয়া যায়, তবে সেখানে আর কবর দেওয়া যাবে না। ওই লাশ ওই খানে রেখে দিতে হবে। যে কবর খোঁড়ার পরে দেখবে সেখানে লাশ নেই, হয়তো কিছু হাড় বা শরীরের কিছু অবশিষ্ট অংশ পাওয়া গেছে, তখন সেই অংশগুলো একসঙ্গে করে অন্য কোথাও পুঁতে ফেলতে হবে এবং ওই কবরে অন্যকে সমাহিত করা যাবে।’ খুব লক্ষ্য করে দেখুন উত্তরটা। এখানে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো কবর খোঁড়ার পর কবরে লাশ পাওয়া যায়, তবে সেখানে আর কবর দেওয়া যাবে না।’ কিন্তু নির্মম বাস্তবতা শুনবেন? এই ঢাকা শহরে সিন্ডিকেট হাড় ব্যবসায়ী আছে, যারা কবরস্থানগুলোয় কর্মরতদের যোগসাজসে মাত্র দুই-তিন মাস পরই গোপনে কবর খুঁড়ে গোটা দেহ সরিয়ে নিয়ে এটি বিভিন্ন চক্রের কাছে বিক্রি করে, যা পরিশেষে ডাক্তারি শিক্ষার্থীদের হিউম্যানবডি এনাটমি সাবজেক্টের কাজে লাগানো হয়। সহজ ভাষায়, মুনাফাখোর দুর্বৃত্তগুলো মরদেহ চুরি করে এগুলো বিক্রি করে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। আর এসব ভয়ঙ্কর অপতৎপরতার সঙ্গে এবার যোগ হলো মানুষের সমাহিত হওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার পৈশাচি তাণ্ডব। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যারা হননি, তারা আমার এই লেখার ভেতর লুকিয়ে থাকা কষ্ট, দ্রোহ ও যন্ত্রণাগুলো অনুধাবন করতে পারবেন কিনা জানি না। যারা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন, তারা রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী, লেখক, সাংবাদিক কিংবা বিবেকসম্পন্ন মানুষ হলে আপনাদের সবার কাছে করজোড়ে অনুরোধ, বিষয়টি নিয়ে কথা বলুন, প্রতিবাদ করুন, সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করুন। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হলেই হয়তো এই নির্মম শহরে অন্তত আমাদের সমাহিত হওয়ার অধিকারটুকু ফিরে পাব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত