রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকে বার বার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় কারণ হলো- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্বলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। বাংলাদেশের নির্বাচনের বড় দুটি দল বা জোট সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে থাকে। দুটি দলের মধ্যে যে বিরোধ তা অধিকাংশ অতীত কেন্দ্রীক, ভবিষ্যৎ নির্ভর নয়। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রের চর্চা তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নাই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা না থাকে, আনুগত্য ও শৃঙ্খলার ঘাটতি থাকে, তাহলে তারা ক্ষমতায় গেলেও দেশের মধ্যে নানা অরাজগতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার আরেকটি কারণ হলো এ দেশের সংবিধান বার বার পরিবর্তন করা। এটা সংবিধানের অন্যতম দুর্বলতা। সংবিধানের নির্বাহী বিভাগের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। আইন সভা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও নির্বাহী বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন বলা হলেও ক্ষমতার উচ্চ পর্যায় থেকে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঠামোও দুর্বল যা কেন্দ্রীয় সরকারের আজ্ঞাবহ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমানো সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে ঋণাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। এতে দেশ ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনের কাজ চলছে। যেখানে নিবন্ধিত ৪৪ দলের ভেতরে ছোট বড় দল নিয়ে ৩০টি দল অংশ নিলেও বৃহৎদল বিএনপিসহ ১৪টি দল নির্বাচন থেকে দূরে আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবি বলেছে সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বুঝায়- তা হচ্ছে না, এটি উদ্বেগের কারণ। এতে যারা ক্ষমতায় যাবে, এদের প্রতি জনগণের আস্থা ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। যা আগামী দিনের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। বিদেশেও হবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিদেশিরাও বিনিয়োগ করবে, স্থানীয় লোকেরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিনিয়োগ বেড়ে যায়, অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো সচল হতে শুরু করবে। আর অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিবে। সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করবে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতির সংকট উত্তরণ কঠিন হতে পারে। নির্বাচন পরবর্তী অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার না হলে যে দলই ক্ষমতায় যাক, তারা মেয়াদপূর্ণ করতে পারবে না। কারণ অর্থনীতিক অবস্থা ভালো না থাকলে কোনো রাজনৈতিক সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। অর্থনীতিক অবস্থার ঠিক না থাকলে এক নায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও ঠিকে থাকে না। কারণ টিকে থাকতে হলে জনগণকে কিছু দিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী বর্তমানে রিজার্ভ কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের ও কম। নির্বাচনকালীন এই সময়ে সরকারের পক্ষে অর্থনীতিতে বড় কিছু করাও সম্ভব নয়। তাই এ সময়ে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমদানির ওপর কড়াকড়ি পরিস্থিতিকে আরো সংকটে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন রপ্তানি বৃদ্ধি, প্রবাসী আয় বাড়ানো। কিন্তু দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে আমদানি-রপ্তানি-বাণিজ্য চলমান রাখার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবরোধ, ধর্মঘট অর্থনীতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করে। ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা মনে করেন এ ধরনের পরিস্থিতি হলে দিনে তাদের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। অর্থনীতিবিদের নানা গবেষণা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির নানা ক্ষতির দিকগুলো পত্রপত্রিকায় ও মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। অর্থনীতি সম্পর্কে খারাপ খবর সবার চোখে পড়ছে। হরতালে যোগাযোগব্যবস্থা, দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ, বন্দরে মালামাল খালাশসহ উৎপাদনমুখী শিল্পক্ষতির সম্মুখীন হয়। যা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর নয়। সবার মতামত ও সংলাপের মধ্যদিয়ে দেশের জনগণের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্যেদিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটিয়ে অর্থনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনার সুযোগ তৈরি হয়। এ জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম ও দেশের জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার মানসিকতা। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শ ও চিন্তার পার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু দেশের অর্থনীতি, জনগণের যানমালের হেফাজত, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণসহ উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার জন্য সবার এক লক্ষ্যে কেন্দ্রীভূত থাকা উচিত। রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, আমাদের রেমিট্যান্সপ্রবাহ, আমদানি-রপ্তানিসহ উন্নয়ন ও উৎপাদনের পথরুদ্ধ হয়ে যাবে। ভুল পথে থেকেও আমরা সঠিক পথে আছি- বললে ভবিষ্যৎতে আরো বেশি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। অর্থনীতির বর্তমান যে সংকট তা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি এখন আর নির্দিষ্ট খাতেও সীমাবদ্ধ নেই। সব খাতে এ সংকট ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা জানি, সামষ্টিক অর্থনীতির চালকগুলো একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। একটি খারাপ হলে অন্যগুলোর উপরেও এর প্রভাব পড়ে। তবে আপাতত ৩টি সমস্যা মোকাবিলা করা জরুরি। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার ও রিজার্ভ পরিস্থিতি। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ব্যাংকিং খাতের উপর নজর দেওয়া। এ খাতে ঋণ আদায়ের হার এত নিচে নেমে এসেছে যে খেলাপী ঋণ বেড়েই চলেছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপী গ্রাহকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে। ব্যাংক খাতের উপর মানুষের যে আস্থা ও বিশ্বাস তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা। পত্রিকার পাতা, মিডিয়ায় ব্যাংকের নানা অনিয়মের খবরে আমানতকারীদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় কাজ করছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ২০২৩ শেষে ব্যাংকিং খাতের খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণের এই পরিমাণ গত সেপ্টেম্বর ২০২২-এর চেয়ে ২১ হাজার কোটি টাকা বেশি। সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত শ্রেণিকৃত ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর এ হার ছিল ৯.৩৬ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। বর্তমানে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এদিকে ডলার সংকট তো কাটছেই না। রেমিট্যান্স কম রপ্তানি আশানুরুপ নয় এবং বৈদেশিক ঋণের প্রবাহও কম। ব্যাংকিং চ্যানেলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এতে দেখা দিচ্ছে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের উপর। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে। এ কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেও ফল তেমন আসছে না। সবমিলিয়ে অর্থনীতির বর্তমানে সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। তা নির্ভর করছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপর। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে একটি ভালো নির্বাাচন প্রয়োজন। নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে তার উপর অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। কারণ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক না থাকলে, কোনো রাজনৈতিক সরকারই টিকতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা না থাকলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় থাকে না। বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সহিষ্ণুতা নেই। তারা একে অন্যকে নির্মূল করে দেওয়ার মনোভাব পোষণ করে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। তাই টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। সংবিধানের নির্বাচনি ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব রাখা যাবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতিতে স্থীতিশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না।