বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ

কঠোরভাবে অনুস্মরণ করা হোক বিল্ডিং কোড

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ ক্রমেই ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এগুলো বড় মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পূর্ব লক্ষণ। ভূমিকম্প রোধ করা সম্ভব নয়। তবে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড পুরোপুরি অনুস্মরণ করার ওপর গুরুতারোপ করা হয়েছে। আস্তে আস্তে ভূমিকম্পের মাত্রা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বড় ধরনের ভূমিককম্প আঘাত হানলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। গত শনিবার সকালে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুসারে, ভূমিকম্পের উৎপত্তি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব-উত্তরে। আর এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ঢাকা থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৩১ সেকেন্ড। রাজধানীর বাইরে রায়পুরা, ভোলা, খুলনা, কোটালীপাড়া, চট্টগ্রাম, দেবীদ্বার, ঝালকাঠি, বরগুনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়ায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘরবাড়ি ভবন থেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসেন। স্বজনদের খবর নিতে থাকে কেউ কেউ। কিছু কিছু স্থানে বড় বড় ভবনে ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ঘরের ছাদ ফেটেছে। কোথাও মেঝের টাইলসে ফাটল দেখা গেছে। ভূমিকম্পের সময় হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ছুপুয়া এলাকায় অবস্থিত আমির শার্ট গার্মেন্টসে শতাধিক কর্মী আহত হয়েছেন। কুমিল্লা মহিলা কলেজে আহত হয়ে চারজন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের একটি ভবনের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়েছে। হলের পাঠকক্ষের দরজার কাচ ভেঙে গেছে। হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আবাসিক হলগুলোতে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আতঙ্কে মাস্টার দা সূর্য সেন হলের দোতলার জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। ভূমিকম্পে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি আবাসিক হলের দেওয়ালে ভয়ংকর ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন হলে থাকা শিক্ষার্থীরা। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান এবং বার্মিজ-এ তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই ঘন ঘন এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে, যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আগে হোক বা পরে হোক, এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। আর সেটাই জানান দিচ্ছে- এই ছোট ভূমিকম্পগুলো। ৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর অভিমত, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর সৈয়দ হুমায়ূন আখতার ভূমিকম্পের এই উৎপত্তিস্থলকে সাবডাকশন জোন (সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চল) হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, এই জোনে যে বিপুল শক্তি প্রায় হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে, তাতে যেকোনো সময় ৮ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ছোটোখাটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ। সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে সরকার যে পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সেটাতেও কিছুটা ভুল আছে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি যেন না হয়, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে কোথায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে, কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক দল দ্রুত পাঠাতে হবে, কোনো জায়গাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা কার্যত দেখা যাচ্ছে না। তবে অচিরেই ভূমিকম্পের আগাম বার্তা কীভাবে পাওয়া সম্ভব, সেটির পাশাপাশি ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজ পরিচালনা করার জন্য অবিলম্বে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।