ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত মানবসম্পদের উন্নয়ন

রায়হান আহমেদ তপাদার
টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত মানবসম্পদের উন্নয়ন

মানুষ কিছু সহজাত ও সুপ্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সহজাত ও সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ পেলে জ্ঞান-দক্ষতা-প্রজ্ঞা-প্রগতিশীলতা দ্বারা সমৃদ্ধশালী, স্বনির্ভর দেশ গড়ার মহতি প্রচেষ্টায় জাতি গঠনের পথ আরো প্রশস্ত হবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টি হিসেবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তখনই বজায় থাকে, যখন তার কর্ম ও দক্ষতার মাধ্যমে পৃথিবী জয় করে। সে সফল ও সার্থক এবং নিজেকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। মানবসম্পদ হচ্ছে মানুষের শক্তি, দক্ষতা, মনোবল, মেধা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান; যা পণ্য উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়ে থাকে। যে কোনো দেশের উন্নয়নে সে দেশের জনশক্তি তথা মানবসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বর্তমানে বাজারের অবস্থা এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামোয় শ্রমিকদের জীবনধারণ সম্ভব নয়। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। খাদ্য মূল্যস্ফীতি অক্টোবরে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে। সুতরাং বছরে পাঁচ শতাংশ হারে মজুরি বাড়িয়ে শ্রমিকদের জীবনধারণে স্বস্তি দেওয়া যাবে না। বাজারে প্রতিদিনের পণ্যমূল্য দেখলে মূল্যস্ফীতির ভয়াল রূপটি উঠে আসে। আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাজার সদাই পর্যালোচনা করে দেখেছি, মাছ-মাংস ছাড়াই খাবারের জন্য চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় ৭ হাজার টাকার ওপরে। যদি সাধারণ খাবার খরচই এত হয়, তাহলে বাড়িভাড়া, যাতায়াত খরচ, শিক্ষা খরচ, চিকিৎসা ব্যয়সহ পরিবারের মোট ব্যয় কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! শ্রমিকরা ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছিলেন। বাজারের সঙ্গে বিবেচনা করলে তাদের চাহিদা বেশি নয়। তবে মালিক পক্ষ বলছেন, তাদের তো মুনাফা বাড়ছে না। যেসব ক্রেতার কাছে তারা পোশাক বিক্রি করছে, সেখান থেকে তারা বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে সেখানে তাদের রপ্তানি আয় বাড়ার কথা। কিন্তু তারা বলছেন, কাঁচামালের আমদানি খরচ, পরিবহন ব্যয় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যয় ইত্যাদি বেড়েছে। তাই তাদের মুনাফা বাড়েনি। কিন্তু তাই বলে শ্রমিকের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে দেওয়া যাবে না, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে তাদের একটি যৌক্তিক মজুরি না দিলে তৈরি পোশাক খাত টিকে থাকার ঝুঁকিতে থাকবে। কেননা, পশ্চিমা দেশগুলো শ্রমঅধিকার এবং মানবিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার। কমবেশি সবারই জানা, আমাদের দেশে ঘুষ বা দুর্নীতির চর্চাটা অনেক বেশি এবং সরকারি সেবা পেতে সবাইকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। যদি কেউ ঘুষ না দিতে চায়, তাহলে তার কাজ বিলম্বিত হয় কিংবা কখনো কখনো কাজটা হয়ই না। এ টাকা দেওয়াটাকে ঘুষ না বলে অনেকে বলেন স্পিডমানি। নাম যা-ই হোক না কেন, কাজ করাতে কিন্তু অর্থ দিতে হচ্ছে। এ ধরনের অর্থের লেনদেন বন্ধ করা এত সহজ নয়। যেহেতু এটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। অনিয়মটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটি বন্ধ করতে হলে কঠোর হস্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অথচ সরকারি সেবার জন্য জনগণ তো কর দিচ্ছেই। তাহলে এ বাড়তি অর্থ কেন? পুরো প্রশাসনিক কাঠামোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্প খাত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কারণ আমরা শিল্পায়নকে এখনো বহুমুখী করতে পারিনি। আমাদের শিল্প খাত এই একটি খাতের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু শিল্প খাত নয়, আমাদের পুরো অর্থনীতির ভিত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি বড় অংশ আসে এ খাত থেকে। এ খাতের বাধাগুলো দূর করতে না পারলে এবং খাতটিকে দুর্নীতি মুক্ত করতে না পারলে এ খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে না। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য একটি মজুরি বোর্ড গঠিত রয়েছে। যেখানে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি থাকে। এই বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্য হলো, ত্রিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা। প্রতি ৬ বছর পর পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, শ্রমিকদের চাহিদার অনেক নিচে মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণ করে। আর এটি সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় মজুরি বোর্ড হলেও শ্রমিকদের পক্ষে কেউ কথা বলে না। এমনকি সরকারও শ্রমিকদের পক্ষে থাকে না। সরকার মালিকদের চাপের মুখে শ্রমিকের স্বার্থ পুরোপুরি চায় না। তাই শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। কিন্তু তাতেও তাদের চাহিদাকে আমলে নেওয়া হয় না। বরং দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকদের জীবনহানি হচ্ছে। শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করার জন্য সহিংস পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। নিজের ঘাম আর শ্রমের বিনিময়ে পরিবার নিয়ে জীবনধারণের জন্য একটু বাড়তি মজুরি চাইতে গিয়ে জীবনটাই যদি চলে যায়- এর চেয়ে করুণ ঘটনা আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের আর সস্তা শ্রমিকের দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রতিযোগিতা করা উচিত নয়। সস্তা শ্রমের পরিচয় নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন টিকে থাকা যাবে না। কারণ শ্রমিককে ন্যায্য মজুরি দেওয়া শ্রমঅধিকার এবং কমপ্লায়েন্সের অংশ। কমপ্লায়েন্ট কারখানা মানে তো শুধু ভবনের নিরাপত্তা, আগুন-নিরাপত্তা, সবুজায়ন এসব নয়, শ্রমিকের নিরাপত্তাও এর অংশ। আমরা যদি শ্রমঅধিকার আইন বাস্তবায়ন না করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের রপ্তানি বাধার সম্মুখীন হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত