সম্ভাবনার বায়ুবিদ্যুৎ

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারা বিশ্বই এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এর বিকল্প নেই। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কয়েকটি দিক রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রধান উৎস হিসেবে দেখা হয় সৌরশক্তিকে। যদিও বায়ুশক্তি এবং পানির স্রোত কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে তার উৎপাদনক্ষমতা খুব কম। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, সৌরশক্তি থেকে বায়ু শক্তিকে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হচ্ছে। বিশ্বজুড়েই বায়ুশক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বায়ুর গতি কমপক্ষে ৭-১০ এমপিএইচ (মাইল পার আওয়ার) হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ইউরোপের ডেনমার্ক, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, সুইডেন প্রভৃতি দেশে এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, একবার বসানো হলে এর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। বায়ুতে চলে বলে এর কোনো জ্বালানি খরচ নেই। ২০০৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবী ব্যাপী ১২১.১ গিগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড পাওয়া যায়। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১.৫ শতাংশ বায়ুবিদ্যুৎ। পুনঃব্যবহার ও জ্বালানিবিহীন হওয়ায় এর উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সমুদ্রতীর, পাহাড়ী এলাকা এবং বাতাসের প্রবাহ বেশি রয়েছে এমন স্থানে বায়ুকল দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। প্রাচীন আরব যুগে আধুনিক নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনে বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। ১৩০০ শতকে এই বায়ুকল সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালে ডেনমার্কে ১২-১৫ মিটার উচ্চতা ও ২০ মিটার ব্যসবিশিষ্ট ২০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ু টারবাইন নির্মিত হয়। ২০৪১ সাল নাগাদ মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে চায় সরকার। কক্সবাজারের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দৈনিক গড়ে ২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পরীক্ষামূলকভাবে সরবরাহ করছে জাতীয় গ্রিডে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সমুদ্রে বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কেন্দ্রটি নির্মাণে যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের তিন প্রতিষ্ঠান। এই কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা হবে ৫০০ মেগাওয়াট। ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সবুজ বিনিয়োগ প্রস্তাবে সম্প্রতি সরকারের প্রাথমিক সম্মতি মিলেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সমুদ্রে নির্মাণ করা প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রাথমিক নিরীক্ষা অনুযায়ী, প্রকল্পটির নির্মাণকাজের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজারো চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া প্রকল্পটির প্রথম ৩০ বছরের পরিচালনাকালে উচ্চতর দক্ষ পদে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। ১৯৮২ সালে একটি প্রাথমিক গবেষণায় দেশের ৩০টি আবহাওয়া তথ্য স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা থেকে প্রাপ্ত বায়ুগতি ছিল বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান। এরপর আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বায়ুশক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০০৫ সালে ফেনীর মহুরী নদীর তীর ও সোনাগাজী চরাঞ্চল ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ছয় একর জমির ওপর স্থাপিত হয় বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলেও পল্লী বিদ্যুতের একটি ফিডারে যোগ হয়ে তা বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা হলেও মেটাতে সক্ষম হচ্ছে।

২০২০ সালে যত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে তার মাত্র ৫ শতাংশ এসেছে বায়ুশক্তি থেকে। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি হতে ১৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি উৎস হতে মোট ১ হাজার ১৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উৎস হিসেবে বায়ুবিদ্যুতের আকার দিনে দিনে আরো বড় হবে। তিনি বলেন, দেশের ৯টি স্থানে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বায়ুপ্রবাহের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ওয়াইল্ড ম্যাপিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। সার্বিক উপযুক্ততা যাচাই করে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এনার্জিট্র্যাকার এশিয়ার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশের মোট ৭২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র। এখানে দূষণমুক্ত শক্তিটি উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে তাদের মতে, বাংলাদেশের আছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস ব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা, যা এখনও অব্যবহৃত রয়েছে।

কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াটের, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট ও চুয়াডাঙা জেলার মোট ১০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আরো তিনটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। গত বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ২০২১-৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্র পূরণ কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তথ্যে জানা যায়, সরকারের নেয়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা তেরখাদায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদুৎকেন্দ্র, চুয়াডাঙায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৪২ মেগাওয়াট বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৭০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদুৎকেন্দ্র, জামালপুরে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, জামালপুরে ৮৫২ কিলোওয়াট রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, সিলেটে ১০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, পঞ্চগড়ে ৫০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, চাঁদপুরে ৭ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, নীলফামারীর ডিমলায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, পঞ্চগঞ্জের দেবীগঞ্জে ২০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, ধামরাইয়ে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জে ৬ মেগাওয়াট বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। এসব প্রকল্প থেকে আগামী ২০২৪ সালের জুন নাগাদ সুফল পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে। তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ ৯৪৮ দশমিক ৫৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সোলার ৭১৪ দশমিক ৬, বায়ুবিদ্যুৎ ২ দশমিক ৯, জলবিদ্যুৎ ২৩০, বায়োগ্যাস ০.৬৪ এবং বায়োগ্যাস ০.৪ মেগাওয়াট। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে বায়ুবিদ্যুতেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশের উপর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ‘অ্যাসেসমেন্ট অব উইল্ড পাওয়ার ইন বাংলাদেশ’ সরকারের কাছে প্রদান করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হলে দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৩০ শতাংশের উৎস হতে পারে বায়ুচালিত টারবাইন। যদিও এখনও বায়ুবিদ্যুৎ এখনও প্রসারিত হয়নি। সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে বায়ুবিদ্যুতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সে সম্ভাবনার ফল তুলতে এর মধ্যেই সরকার ব্যাপক প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছে। বর্তমান জ্বালানি সংকট পৃথিবীকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। বহু বছর ধরেই পৃথিবী বিকল্প শক্তির সন্ধানে হন্য হয়ে ছুটছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো জন্য প্রয়োজন হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই উৎপাদনের অর্ধেক অর্থাৎ ২ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে। পানি ও বায়ুর ব্যবহার করে উৎপাদন হবে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যা সর্বমোট সক্ষমতার প্রায় ৩ শতাংশ। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা রোধ করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার মতো কার্যকর আর কোনো পদক্ষেপ নেই। গবেষকরা বলছেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বায়ুশক্তি ও সূর্যশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে। এর ফলে কমেছে কয়লার মতো জীবাশ্ন জ্বালানির ব্যবহার। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমছে, অন্যদিকে জ্বালনিতে স্বনির্ভরতা অর্জনেও সাহায্য করছে, যা ভবিষ্যতে বর্তমান যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক অস্থিরতাজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যায় মাথাব্যথার কারণ হবে না।