বাঙালির দেশপ্রেম ও চেতনার সংকট

এস এম মুকুল

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কথায় কথায় অনেকে বলেন- বাঙালির দেশপ্রেম নাকি শুধু দেশি মুরগির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তারা দেশি সিনেমা দেখে না, নাটক দেখে না, দেশের কাপড় পরে না, ঠিকমতো দেশের ভাষায় কথাও বলে না- অথচ মুরগি কেনার সময় দেশি মুরগি ছাড়া তাদের চলেই না! কোনো এক বয়োজ্যেষ্ঠ বলছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু এমনি এমনি আর বাকশাল করতে চাননি। তিনি যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন এই জাতির চেতনা কীভাবে ফেরাতে হবে!’ কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভেতরে স্বপ্ন নয়/কোন এক বোধ কাজ করে!/স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!’ ২০২০ সাল ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বর্ষ- ‘মুজিব বর্ষ’। ২০২১ সাল ছিল স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বর্ষ। কিন্তু এরই মধ্যে করোনা এসে অকরুণভাবে সবকিছুকে থামিয়ে দিল। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়- স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা আজো সেই বোধের অভাব তীব্রভাবে বোধ করছি। দেশপ্রেম এখন লাটে নয়, লুটে উঠেছে। চলছে লুটপাটের মহোৎসব। আর লুটতরাজকারিরা শীর্ষ আসনে বসে গলা ফাটানো ভাষণে দেশপ্রেমের তকমা গিলাচ্ছে নিরীহ জনগণকে। দেশপ্রেম আসলে কী? দেশপ্রেম ভাষণ-সম্ভাষণে প্রকাশ করার বিষয় নয়। দেশপ্রেম হলো নাগরিকের নির্মল ও পবিত্র আবেগ- যার প্রকাশ ঘটে দায়িত্ববোধ, বিনয়, সহনশীলতা আর আপন আদর্শ বিস্তারের মধ্য দিয়ে। সেই দেশপ্রেমিকরা কোথায়? দেশপ্রেম থাকার কথা রাজনীতিতে- সেখানে বইছে দেশ লুটেপুটে খাওয়ার হুলি খেলা। দেশপ্রেম থাকার কথা জনপ্রশাসনে- তারা যেন রাজনীতিবিদদের দৈনতাকে পুঁজি করে নিজেরাই লুটতরাজের অংশীদার। শিক্ষকরা এখন শহীদ মিনারে অনশন করে অধিকার আদায়ে- আর পুলিশরা লাঠিপেটা চালায়! এই শিক্ষকদের ছাত্ররাই পুলিশ, এমপি, মন্ত্রী-সেপাই। সবখানে ঘুণে ধরেছে। নিয়ম মানে না কেউ- যদিও বা নিজেরা সব ভালোর পক্ষে কথার ঘূর্ণিপাকে তুলে ঢেউ। অনেকে বলেন- রাজনীতিকরা নীতিবান হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কথাটি কতটা সত্যি। যদি তাই হবে, তবে ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার টিকে যেত। তখন সেই সরকারে পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- সব ঠিক করতে হলে পুরো বাংলাদেশকে কারাগার ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অকপটে বলেছিলেন- ‘সবাই দেশ স্বাধীন করে পায় সোনার খনি, আর আমি পেলাম চোরের খনি।’ দেশপ্রেম তাহলে কীভাবে বিস্তার লাভ করবে? একজন দেশকে ভালোবেসে বিসর্জন দিয়ে না খেয়ে মরবে- অপরজনরা তাকে বাহবা দিয়ে নিজেরা অনিয়মের স্বর্গে বাস করবে? আমাদের চৈতন্য যেন নির্লিপ্ত গভীর শীতঘুমে। তবে বোধ যে একেবারে মরে গেছে তা নয়, চেতনাও আছে। আমাদের চেতনা এখন কয়েকটি মাস আর কিছু দিবস উদযাপনেই অধিক তৎপর দেখা যায়। ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং এপ্রিল চারটি মাসে গড়পরতা সবখানে চেতনা যেন লুটোপুটি খায়। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস, ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস, মার্চ স্বাধীনতার মাস আর এপ্রিল আমাদের বাঙালি স্বকীয়তার মাস। বাকি সময়ে চারিদিকে দেখা যায় চৈতন্যের সংকট। কবিতার ভাষায়- ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে,/জ্বলে উঠল আলো- পুবে পশ্চিমে।’ কবিতার মতো আসলে সবকিছু হয়ে উঠে না। আগে কবিদের কবিতায় ঝড় উঠতো। কবি-সাহিত্যিকরা দলবেঁধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতেন। আর এখন যে সুবিধা পায় সে চুপ যায়! আর বাকিরা ঘেউ ঘেউ করে বেলা-অবেলায়! বাঙালির চেতনা সত্যিই রহস্যময়। তা না হলে ‘হুজুগে বাঙালি’র প্রবাদ রচনা হতো না হয়তোবা। আবার একথা সত্যি, চেতনার জাগরণ সৃষ্টি হলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে এই বাঙালিরাই। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বহুবার, বহুভাবে প্রমাণিত হয়েছে একথা। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে ফেসবুকে চেতনার তীব্র জাগরণ দেখা যায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোলপাড় সৃষ্টি করে ফেসবুকাররা। তারপরও ভোটে একশ সৎলোক বা ভালো মানুষ জিতে আসতে পারে না। এমন চেতনা দিয়া আমরা কি করিব। আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে সরাসরি ভোট হয়। ১০০ জন ভালো মানুষকে জিতিয়ে নিয়ে আসা দরকার। তারপরের বার ২০০ জনকে। এরপর বাকিরা এমনিই সোজা পথে আসবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই প্রত্যাশায় পথ চেয়ে বসে আছে জনগণ। কবে জাগবে চৈতন্য? বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশ অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষা আর আত্মদানে বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। দেশে ৫২ বছরে যে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তার কিছুই হইনি হয়তোবা। তারপরেও অনেক বাঁধা পেরিয়ে, অনেক সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় দেশটি। আমরা যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে কি পারছি। রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, অনাদর্শিক দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে অফুরন্ত সম্ভাবনাকে সামনে যেতে পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্নীতি আর অনিয়মের হোলি খেলায় জাতি, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম হতাশ। তবে হতাশার মধ্যেও আশার আলো খুঁজতে হবে। রাজনীতিতে ত্যাগী, ইতিবাচক, দূরদর্শী মানুষও আছে। সঠিক লোককে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করতে জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানতম জাতীয় ইস্যুগুলোতে একমত হতে পারছে না আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক, মুক্তিযোদ্ধাদের যার যা ভূমিকার মূল্যায়ন হওয়া দরকার। আমাদের বাঙালিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শে সবার একমত হওয়ার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা রাখার সময় এসেছে। আমাদের সরকারি দল প্রশাসন ও বাহিনীগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করে তা যেমন ঠিক নয়। তেমনি বিরোধী দল যেভাবে বাহিনীগুলোকে বিষোদ্গার করে সেটিও ঠিক নয়। কারণ এই বাহিনীকে অতীতে তারাও ব্যবহার করেছেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতা পেলে তাদেরই ব্যবহার করতে হবে। তাহলে কেন এই বিষোদ্গার করে বাহিনীগুলোর বদনাম করা হচ্ছে। মানবাধিকার, নিরাপত্তা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশ সময়ে সময়ে বাংলাদেশকে উপদেশ বাতলায়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগেই এদের কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে আমাদের সচেতন মিডিয়াও কম দায়ী নয়। কিছু হলেই বিদেশি কূটনীতিকদের মতামত চাওয়া হয়। বিরোধী দল ছুটে যায় নালিশ দিতে- এই নিচুতা আমাদের অগ্রযাত্রার প্রধান প্রতিবন্ধক। তথ্য-তল্লাশি করলে দেখা যায়, যারা আমাদের দেশকে নিরাপত্তার জন্য উপযোগী মনে করে না তাদের দেশ আরো বেশি অনিরাপদ। সে বিষয়ে আমরা কি কথা বলতে পারি? বাংলাদেশ উদার ধর্মস্বাধীনতার দেশ এতে কোনো সন্দেহ নেই। নানান অজুহাতে বাংলাদেশের মুক্ত সাংস্কৃতিক আভিজাত্য ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সুদৃঢ় অবস্থানকে ভন্ডুল করার পাঁয়তারা করছে বিশ্বচক্র। সব বিষয়ে আমাদের আরো সচেতন, সোচ্চার, কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া বোঝা। তাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ বিশেষ মানবিক কারণে। বাহবা পেয়েছে বিশ্ব নেতাদের। কিন্তু সবাই মিলেও এই দায়ভার নিচ্ছে না। মিয়ানমারকে বাধ্য করছে না- তার দেশের নাগরিকদের তারা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। এটিই বিশ্ব রাজনীতির নোংরা খেলা। যারা মনবতার নামে অহর্নিশ পদদলিত করছে মানবিক মূল্যবোধকে। সবার আগে মূল্যবোধের চর্চা নিজের ও সমাজের মাঝে বিকশিত করতে হবে। দেশের জন্য চাই ত্যাগী, আদর্শ, সৎ ও সাহসী নেতৃত্ব। চাই তরুণ মেধাবী ও সাহসী নেতৃত্বের অবারিত প্ল্যাটফরম। স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমি ভিক্ষুক দেশের নেতা হতে চাই না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে- আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।’ ৫২ বছর পর সে স্বপ্ন বাস্তবের পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। এভাবে বহুদিনে জীবনচর্চায় আইনি বাধ্যকতায় সবার আগে অভ্যাসের পরিবর্তন জরুরি। নিয়ম মানার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক পেশাজীবী যে যার অবস্থান থেকে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করা এবং পেশাগত সততার স্বাক্ষর রাখা। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসা। সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। সরকার অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা, ভালো কাজ করলে ধন্যবাদ জানানো। তেমনি বিরোধী দল সরকারের খারাপ কাজের প্রতিবাদ না করলে বা জনগণের পক্ষে জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা না রাখলে নিন্দা করা আবার সরকারের ভালো কাজে পাশে না থাকলেও নিন্দা জানানো। ধর্মীয় অনুশাসন মানা এবং অন্য ধর্মের প্রতিবিদ্বেষী না হওয়া। এসব অভ্যাসগত পরিবর্তনই হবে নৈতিক পরিবর্তনের চাবিকাঠি। একাজটি শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব হবে না। উদ্যোগটি নেবে সরকার- সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি করে কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে। নৈতিকতা ও দেশপ্রেম সব পেশা এবং নাগরিক সমাজে না থাকলে শুধু পুলিশের পক্ষে ভালো হয়েও পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। ৫২ বছরের অনিয়মের ঘুণপোকা অতসহজে সারবে না। অভ্যাসের পরিবর্তন আনতে হলে উদ্যোগটিও আসতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই। উন্নত দেশগুলোতে ছোট ছোট অপরাধের তাৎক্ষণিক বড় শাস্তি কার্যকর হয়। অভ্যাস পরিবর্তনে এটি টনিক ট্রিটমেন্ট। রোড সিগনাল মেনে চলা, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলা, প্রচলিত আইন মেনে চলা, রাষ্ট্রকে আয়কর দেওয়া, সঠিক নিয়মে ভ্যাট প্রদান, ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ছিনতাই, ধর্ষণ-অপহরণ, শিশু ও নারী নির্যাতন, খাদ্যে ভেজাল, চিকিৎসায় বিড়ম্বনা, জাল-জালিয়াতি, পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা প্রভৃতি অপরাধের তালিকা প্রণয়ন করে বিশেষ আদালতে তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানা করতে হবে। ছোট অপরাধে দ্রুত শাস্তি প্রয়োগ হলে বড় অপরাধের প্রবণতাও কমে আসবে। আইনের শাসন মেনে চলবে। সরকারকে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ছোট অপরাধ দমনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি দেশের শিল্প সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তাদের বিকাশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মসংস্থানমুখি করতে হবে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ অবারিত করতে হবে। তরুণ সমাজকে শিক্ষা শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজে লাগাতে হবে। তাহলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনীতি লাগবেই। রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই তরুণ প্রজন্মের সামনে আদর্শের মডেল হতে হবে জনপ্রতিনিধিদেরকেই। এই করোনাকাল শেষ হলে নতুন পৃথিবীর বাসিন্দা হব আমরা। নতুনভাবে বাঁচার পরিকল্পনা করব- এই হোক অঙ্গীকার। ভুল-ভ্রান্তি, হিংসাবিদ্বেষ ভুলে চেতনার জাগরণে চলুন এগিয়ে যাই, এগিয়ে নিয়ে যাই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে।

লেখক : সাংবাদিক, বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক।