বিজয়ের মাস ও বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম নীতি

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ডিসেম্বর আমাদের গৌরবের ও গর্বের মাস। এ মাসেই আমরা স্বগর্বে মাথা উঁচু করার স্পর্ধা অর্জন করেছি। ডিসেম্বর মাস আসলেই আমাদের বিজয়ের বীন হৃদয়ে বাঁজে। মনে একটা আনন্দের অনুভূতি অনুভূত হয় দেশাত্মবোধ থেকে। এই বাংলার স্বাধীন চেতা অনুভূতিগুলো যেন জাগ্রত হয় বাঙালিদের হৃদয়ে। ১৯৭২ সালের ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্রকে নির্বাচন করা হয়। এই চার মূলনীতির ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের উম্মেষ ঘটতে শুরু হয়। বাঙালিরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতা থেকে। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ঐক্যের ডাক পাকিস্তানি আগ্রাসন থেকে এদেশের মানুষকে করে তুলেছিল প্রতিবাদী। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে এদেশের মানুষের মুক্তির দিশারী, আলোক বর্তিকা হিসেবে স্থান পায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি হায়েনারা যখন এদেশের নীরিহ মানুষের প্রতি অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়নে ব্যস্ত তখন নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষগুলোকে খাদের মাঝখান থেকে তুলেছিল বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই দেশ ও দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। ছাত্রজীবনেই তিনি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সুভাষচন্দ্র বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বাংলা ও ভারতের পৃথকীকরণের মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশের সীমানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ফলে এই অঞ্চলটি নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানে পরিণত হয়। ওই বছরই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়। প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে ছাত্রসমাজ। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

তৎকালীন যেসব ছাত্র ও তরুণের প্রচেষ্টায় এ পরিষদ গঠিত হয় তাদের অন্যতম ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হলে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অধিকাংশ ছাত্রনেতা গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘদিন বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেন বঙ্গবন্ধু। ফলে তাকে বার বার জেল খাটতে হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করায় শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতি চলছিল তখন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে কারাবন্দি তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে করা হয় দলের যুগ্ম সম্পাদক। মুক্তি পেয়ে তিনি দল গঠনের কাজে ব্রতী হন। ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অসামান্য। এটি শাসকগোষ্ঠীও বুঝতে পারে। তাই ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এবার তাকে দীর্ঘ সময় আটক রাখা হয়। জেলে থাকাকালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি অনশন পালন করেন। দুই বছরেরও বেশি সময় কারাগারে থাকার পরে তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে বের হয়ে আবার তিনি সারাদেশে দলকে সংগঠিত করার কাজে গভীর মনোযোগ দেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ করলে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। তখন তাকে পুনরায় কিছুদিনের জন্য জেলে যেতে হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

দুইবার পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৬ সালে তিনি পুনরায় পূর্ব-পাকিস্তানের মন্ত্রী হন। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে সময় দেবেন বলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালির সব ধরনের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করতে পাকিস্তানি শাসকরা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে মামলা করে, যা ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এ মামলায় পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দকে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া। এভাবে নেতৃত্বশূন্য করে আন্দোলন থামিয়ে দেয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন টিকে থাকতে পারেনি। ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান এ মামলা প্রত্যাহার করে সব রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হন। কারামুক্ত শেখ মুজিবকে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বিশাল গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা বা বিলম্ব করতে শুরু করে। বস্তুতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনোভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১ মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এদিন পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগের যৌথ সমাবেশে তিনি বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রথমেই বলেন, ‘হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বিকাল ২টা ৪৫ মিনিটে বক্তব্য শুরু করে বিকাল ৩টা ৩ মিনিট পর্যন্ত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিট ব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।

১৯৭১ সালের ২ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৭ মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি বাঙালির বিজয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে আহ্বান করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ এক অভিন্ন ইতিহাস। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯১ হাজার ৬৩৪ সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এর ফলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এ স্বাধীন বাংলাদেশের রুপকার বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালি ও এদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসের সোনার পাতায় এ মহান ব্যক্তির নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আরো বেশি জাগ্রত হোক আমাদের দেশপ্রেম।