ম্যান্ডেলা তোমাকে মিস করছে পৃথিবী

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার এম্ভেজে গ্রামে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কারণে তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ নেতৃত্বাধীন সরকার তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। তার ২৭ বছরের কারাজীবনের মধ্যে ১৮ বছর কাটাতে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রোবেন দ্বীপের কারাগারে। বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহুবর্ণভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। মহান এই নেতাকে সম্মান জানিয়ে তার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে ম্যান্ডেলা দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ। মানবাধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সাল থেকে জাতিসংঘ চালু করে নেলসন ম্যান্ডেলা পুরস্কার। শান্তির প্রতীক হিসেবে ম্যান্ডেলা ১৯৯৩ সালে ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তাইতো দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত এই নেতার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাসের পর সদ্য মুক্তি পেয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ম্যান্ডেলা সাক্ষাৎ করেন আরেক মুক্তিকামী নেতা ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে। সাক্ষাতে আরাফাতকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ম্যান্ডেলা। তিনি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। যদিও এটা নিয়ে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা ছিল। কিন্তু ম্যান্ডেলা সেসবে কখনোই কান দেননি। ম্যান্ডেলা শুধু ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করতেন তা নয়, আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে ম্যান্ডেলার দীর্ঘদিনের সংগ্রামে সমর্থন জুগিয়ে এসেছে। আর ম্যান্ডেলা আরব ভূখণ্ডে ইসরাইলি আগ্রাসনের ঘোরবিরোধী ছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দশম মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা ভাগ্যবান, তারা (ফিলিস্তিনিরা) আমাদের সমর্থন জুগিয়েছিল। এমন সমর্থনের জেরে আমরা কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন করেছি। ম্যান্ডেলার দাদা বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ। দাদা নেলসন ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) একজন আইনপ্রণেতা মান্ডলা ম্যান্ডেলা। ৩ ডিসেম্বর থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে জোহানেসবার্গে তিন দিনের একটি সম্মেলন আয়োজন করেছেন তিনি। সম্মেলনে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরাও হাজির ছিলেন। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে চলমান সংঘাতের সূচনা। হামলায় ১ হাজার ২০০ ইসরাইলি নিহত হন। বন্দি করা হয় ২৪০ ইসরাইলিসহ অন্যান্য দেশের নাগরিককে। এসব হিসাব ইসরাইল সরকারের। ওই দিনই হামাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় পাল্টা নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। এরপর দুই মাস হতে চলল। মাঝে যুদ্ধবিরতির কয়েক দিন বাদে প্রতিদিনই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। হামলা থেকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, গির্জা, হাসপাতাল কিছুই বাদ যায়নি। হামলায় প্রাণ গেছে সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় ১৯ লাখ এখন বাস্তুচ্যুত। রক্তাক্ত এই সময়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন এএনসির আইনপ্রণেতাদের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এর আওতায় ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে দেশটি। বলা হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্ক স্থগিত রাখা হবে। এএনসির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপপ্রধান ওবেদ বাপেলা বলেন, নিজ ভূখণ্ডে এখনো পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না ফিলিস্তিনিরা। তাদের ভূমি এখনো আগ্রাসী শক্তির দখলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমরাও একসময় অনেকটা একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। বর্ণবাদের সঙ্গে তুলনা করাকে ইহুদিদের প্রতিবিদ্বেষ হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনা করেছে ইসরাইল। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের অনেকে এখনো ফিলিস্তিন প্রশ্নে নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শ ধরে রেখেছেন। ইতিহাসবিদ ও লেখক ডেভিড সাকস বলেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার পরও নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি ১৯৯৪ সালের পর ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সফরে যান। সফরকালে ইসরাইলের মানুষ তাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। আর তখনকার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এবং তৎকালীন ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট এজার উইজম্যানকে তিনি আমার বন্ধু বলে উল্লেখ করেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক লেবোগাং মাশাইলি বলেন, ফিলিস্তিনের প্রশ্নে নেলসন ম্যান্ডেলা কখনোই আপস করেননি। আমাদেরও করা উচিত হবে না। বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্ণবাদণ্ডপরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি। বিভিন্ন সময় মোট ২৭ বছর কেটেছে কারাগারে। শান্তিতে নোবেল পান ১৯৯৩ সালে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক বিশেষ এক অধিবেশনে যোগ দিয়ে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, আমি সারা বিশ্বের সব শিশুর হয়ে এই সম্মাননা নিতে চাই। এই শিশুরাই তো আমাদের আগামী। আমাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা তো তাদের ঘিরেই। আমার প্রজন্মের লোকদের শুধু একটা কাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে করে যেতে হবে। আর তা হলো, আমাদের শিশুদের জন্য আগামীর পৃথিবীকে সুন্দর করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। তারা যেন তাদের পৃথিবীতে খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, নিঃশ্বাস নিতে পারে, সেদিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। একটা বিষয় আমাদের জন্য বেশ হতাশাজনক। একুশ শতকের প্রথম ভাগে পা রেখেও আমাদের ‘সবার জন্য সুন্দর পৃথিবী’ স্লোগান নিয়ে আকুতি জানাতে হয়। বিশ শতকেই তো আমরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জ্ঞানজগতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। তার পরও আমরা কেন পিছিয়ে? আমাদের মধ্যে অনেকেই নতুন পৃথিবী তৈরি করবেন বলে বিশ্বাস রাখেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা অন্যরকম এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করব। যেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্র্য। সেই পৃথিবীতে অসাম্যের কোনো কুছায়া থাকবে না। আমাদের সেই পৃথিবীতে সব মানুষ জাতি-বর্ণগোত্র-নির্বিশেষে শান্তি, নিরাপত্তা আর সমতার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করবে। যেই পৃথিবীতে প্রতিটি দেশ, একেকটি জাতি পরস্পরের সঙ্গে শান্তিতে থাকবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হবে সমতা। কিন্তু বর্তমানে আমরা সেই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে বাস করছি। আমাদের বাস্তবতা এখন ভিন্ন কথা বলে। এই পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা আজ ক্রমাগত দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। বঞ্চনা আর অত্যাচারের মধ্যে কাটছে প্রতিটি মানুষের দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ আর সংঘাত কেড়ে নিচ্ছে অজস্র প্রাণ। দেশে দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে ক্রমাগত। ধনী দেশগুলোর সঙ্গে গরিব দেশগুলোর দূরত্ব আজ সহস্র যোজন। সত্যিকারের সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছি। আমাদের শিশু, তরুণ প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মকে এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। আমরা যা পারছি না, সেটা তাদের করে দেখাতে হবে।

আমাদের পৃথিবীতে জমে থাকা দারিদ্র্য আর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছে ক্রমাগত। উন্নয়নশীল দেশ ও আফ্রিকা মহাদেশের সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যের ভার বহন করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের কথা অবহেলার চোখে দেখা হতো। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই ধারণা বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের আচরণ। তারা এখন দরিদ্র মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। উন্নত দেশগুলোর মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ এখনো উপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এখনকার তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বই পারে সেই শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা আর অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে তারাই পুনঃ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বদলে দিতে পারে পৃথিবীকে। এই তরুণ নেতারাই হবে দেশের ভবিষ্যতের কারিগর। পারস্পরিক সহযোগিতা বর্তমান পৃথিবীর একটি আলোচিত ধারণা। আমরা সারা পৃথিবীর আলোচিত ব্যক্তিত্বদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাদের সহযোগিতায় আমরা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। আমাদের শিক্ষা খাতে তারা অবদান রাখতে পারে। একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নে শিক্ষা খাতের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত শিক্ষাই পারে উন্নত নাগরিক তৈরি করতে। আফ্রিকার উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। বর্তমান পৃথিবীর সার্বিক অবস্থার চিত্র আমাদের ধারণার থেকেও মলিন। সে জন্য আমাদের হতাশ হলে চলবে না। নিজেদের হতাশার চাদরে জড়িয়ে ফেললে চলবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়ার ক্ষমতা আছে। আমাদের সেই শক্তি সর্ম্পকে জানতে হবে, সেই কর্মক্ষমতা দেখিয়ে কিছু করতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে সমাজকে ও সময়কে। তবেই হয়তো কিছুটা হলেও শান্তি আসবে।