ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ)- প্রেক্ষিত : প্রকৃতি, প্রেম ও দর্শন

ড. নাসরিন আক্তার, সহযোগী অধ্যাপক, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ)- প্রেক্ষিত : প্রকৃতি, প্রেম ও দর্শন

‘প্রবাহের জন্য যেমন উচ্চতা ও নিম্নতা আবশ্যক, প্রেমিকের জন্যও সেইরূপ সুখ-দুঃখ সমভাবে আবশ্যক। যে প্রেমে দাহ নাই, সে প্রেমে গৌরব নাই। প্রেম যে স্বর্গীয়, তাই ইহার দাহ ও প্রসাদ সমান উপভোগ্য।’ (পত্র সংখ্যা : ৭। ২১.১.১৯১৭। মধুমতি নদী, অমাবস্যা) তাঁর ‘ভক্তের পত্র’ গ্রন্থের এই অংশটুকু যেদিন পড়েছিলাম; সেদিন এক অনন্যরূপে তাঁকে আবিষ্কার করেছিলাম। ভক্তের পত্রের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে এরূপ অসংখ্য আত্মোপলব্ধির হীরক দ্যুতির প্রচ্ছটা। অবশ্য, হয়তো তেমনটি হওয়ার কথা, কারণ দর্শন যাঁর অধিত বিষয়ছিল, তাঁর জগত বা জীবনকে দেখার দৃষ্টি ভূলোকের আকর থেকে জারিত হয়ে অসীমের সন্ধানে ছুটে যাওয়ারই কথা। তাঁর ‘ভক্তের পত্র’ কোনো এক অচেনা তরুণ কবির প্রতি রিলকের চিঠিগুলোর (Letters to a young poet by Rainer Maria Rilke) কথা মনে করিয়ে দেয়। তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার জীবন ধারা’ কেবল এক সাধারণ জীবনী গ্রন্থ নয়, তাঁর জীবন প্রবাহের এক অবিস্মরণীয় চালচ্চিত্রের সাথে আত্মদর্শনের এক অপূর্ব সম্মিলন। যেখানে তাঁর মানুষ থেকে মানব হয়ে ওঠার ধারাবাহিক পর্যায়গুলো পর্বেক্ষণ করলে যে কারো কাছে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি মাটির পৃথিবীর মানুষ হয়ে এই মাটির বুকেই স্রষ্টার সৃষ্টির মাঝেই তাঁর অস্তিত্ব আর অরূপরূপের সন্ধান পেয়েছিলেন। ‘যখন ক্ষুদ্রঘাস-ফুলের মধ্যে অচিন্ত্য শিল্পের পরিচয় পাই, যখন গোলাপের সুগন্ধ মনকে ভরপুর করে, যখন পাতাবাহার দৃষ্টি শক্তিকে হরণ করে, যখন পাখির কূজনকর্ণকুহরকে তৃপ্ত করে, যখন প্রাতঃকালীন বা সান্ধ্যকালীন হিল্লোল শরীরকে শীতল করে, তখন চমকিতে দয়াময়ের অফুরন্ত দয়ার কথা মনে পড়ে। তাঁহার সৃষ্টিকৌশল আত্মাকে মুগ্ধ করে, বুক ধড়ফড় করিতে থাকে, আর প্রেমময়ের সান্নিধ্য কলবকে তোলপাড় করে... (আমার জীবন-ধারা)।’ প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের নিবিড় পর্বেক্ষণ তাঁর বোধকে করেছে তীক্ষ্ম আর গভীর থেকে গভীরতর এক অসীমের অনুসন্ধান তাঁর জীবনকে এক আশ্চর্যান্বিত উপলব্ধিতে সিক্ত করেছে। এই বস্তু জগতের রহস্য, ঈশ্বর আছে কি না থাকলে কোথায়, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী, আমরা কোথায় ছিলাম, কোথায় যাব- এইসব প্রশ্নের উত্তর তিনি নিরন্তর খুঁজতে গিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন এক অদৃশ্য অন্তর্জগতের; যার বিভাস প্রকৃতির মধ্যেই অম্লান। তিনি জোড়াবদ্ধ বিহঙ্গকুল চরতে দেখে প্রেম তরঙ্গে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন। প্রতিটি বৃক্ষের প্রতিটি পাতা, প্রতিটি কীট, প্রতিটি পশু-পাখি তাদের নিজ স্বতন্ত্র ভাষায় সেই অনন্ত অসীমের গুণকীর্তন করে চলেছে- এই ছিল তাঁর বোধিসত্ত্ব। তাইতো শালিক, হাঁস, কবুতর কোনো কিছুই তার দৃষ্টির অন্তরালে থাকে না (এই খানে আমার কবি জীবনানন্দকে মনে পড়ে)।

সৃষ্টির মাঝে তাঁর এই নিরাকার সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে খুঁজে ফেরার সাথে যদি আমরা সপ্তদশ শতাব্দীর দার্শনিক বা রুখ স্পিনোজার (১৬৩২-১৬৭৭) ঈশ্বরের ধারণার একটা সাযুজ্য নিরূপণ করার চেষ্টা করি, তাহলে সহজে অনুমেয় কতটা উচ্চমার্গের দার্শনিক তিনি ছিলেন, কোন নিসর্গের ভেতর তিনি আপন অস্তিত্বের আকর সন্ধান করেছিলেন। সেটিই তার জন্য হয়তো ভীষণ প্রযোজ্য ছিল কারণ দর্শনের মতো একটা বিষয়ে একাডেমিক পড়াশোনা করে তিনি যে যুক্তির কষ্টিপাথরে নিজেকে যাচাই করে নেবেন, সেটাই তার ভাষায় তার দয়াময় মহা প্রভুর ইচ্ছা ছিল এবং সেই ইচ্ছার প্রতি তিনি সমর্পিত ছিলেন। বারুখ স্পিনোজার মতে মহাবিশ্বের সবকিছুতেই আছে ঐক্য। আর সেই ঐক্যকে তিনি দেখালেন ঈশ্বর ও প্রকৃতির অভিন্নসত্তা রূপে। বারুখ স্পিনোজার মতে, যে জিনিসের অস্তিত্ব আছে, তার মধ্যে ঈশ্বর আছে। ঈশ্বরের ধারণা ছাড়া অন্য কোনো ধারণাকেই গ্রহণ করা সম্ভব নয় এবং গ্রহণ করা হবেও না। কেন না প্রকৃতিতেই বাঁচেন ঈশ্বর, এখানেই হন আন্দোলিত। তার মতে, ঈশ্বরই সব, সবই ঈশ্বর। ঈশ্বর জগতকে সৃষ্টি করেছেন সেটার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে নয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) এঁর কথায় আমরা তারই যেন প্রতিধ্বনি পাই, ‘বায়ু, তাপ, বিদ্যুৎ যদি সারা পৃথিবী জুড়িয়া থাকিতে পারে, তবে কি তাহাদের স্রষ্টা আকাশ-পাতাল ব্যাপিয়া থাকিতে পারেন না? খোদারই বেলায় কি যুক্তি বিদায়লয়? (আমার জীবন-ধারা)’ তিনি জার্মান দার্শনিক কান্টের মতবাদকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘খোদা অসীম, সসীম মানুষ তাঁহাকে সসীমের বেড়ির মধ্যে আনিয়া বুঝিতে চায়। সসীম হইয়া সে অসীমের পূর্ণ ধারণা কিরূপে করিবে?’

কান্টের মতে, আমাদের চিন্তা ‘কাল ও স্থানের বেড়ি’ ভেদ করতে পারে না। যে বস্তু আমরা চিন্তা করি, সেই বস্তুতেই অবয়ব ও কাল আরোপ করি। কিন্তু ঈশ্বর তো কোনো কাল বিশেষ বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানেও সীমাবদ্ধ নন। তিনি যেমন বিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন, তেমনি বিশ্বের বাইরেও আছেন।

সাক্ষ্য-দর্শন মতে তিনি বিশ্বাতিগ (Immanent) অর্থাৎ বিশ্বের প্রত্যেকে বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান আবার বিশ্বাতীতও।

কিন্তু স্পিনোজার ঈশ্বর ধারণার (Pantheism) সাথে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) এঁর ঈশ্বরের ব্যাপক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পার্থক্য পরিলিক্ষত হয়, তখন স্পিনোজার ঈশ্বর নিজেই নিজেকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয়। অর্থাৎ, স্পিনোজার ঈশ্বর হচ্ছেন কেবল Immanent। তিনি বিশ্বাতীত নন। তিনি সমস্ত উপাসনালয় ভেঙে দিতে বলেছেন, পবিত্র গ্রন্থ পড়া বন্ধ করতে বলেছেন, তার প্রশংসা করতে নিষেধ করেছেন। যে জীবন তিনি (ঈশ্বর) দিয়েছেন, সেই জীবনকে উপভোগ করতে বলেছেন, সচেতন হতে বলেছেন (তার মানে দাঁড়ায় একজন ঈশ্বর, তিনি আছেন এই সৃষ্টি জগতের বাইরেও)। স্পিনোজার ঈশ্বর ধন্যবাদ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন তাই তিনি ধন্যবাদ চান না। তার মতে, জীবন কোনো পরীক্ষা ক্ষেত্র নয়, এখানে পাপ-পুণ্য লেখার কেউ নেই। তাই জীবন হচ্ছে প্রাপ্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আনন্দোৎসব করার জন্য।

স্পিনোজার মতে, যেসব জিনিসের অস্তিত্ব রয়েছে, তাকে যে মৌলিক একক বাস্তবতায় নিয়ে আসা যায়, সেটাই হচ্ছে substance বা সারবস্তু। এই বিশ্বজগতের সাবস্ট্যান্স বা সার বস্তু কী? স্পিনোজার ভাষায়, তা হলো সেই অস্তিত্ব, যা নিজেতেই ব্যাপ্ত এবং যার ধারণা স্বয়ং সম্পূর্ণ। অন্যভাবে বললে, যা থেকে অন্য কোনো ধারণার সাহায্য ছাড়াই একটি ধারণার জন্ম হতে পারে। একে কখনো তিনি বলেছেন প্রকৃতি, কখনো ঈশ্বর। গোটা নিখিল আর তার সবকিছুকে তিনি দেখেন ও দেখান একটি একক বাস্তবতায়। বস্তুগত সবকিছু, আধ্যাত্মিক সব কিছুও।

আডবার ডেকার্তের সার বস্তুছিল দুই ধরনের। প্রতিটি বস্তুকে তিনি দেখেছেন দুই সম্ভাব্যতায়। হয় সেটি চিন্তা, নয় ব্যাপ্তি। বাস্তবতার উপলব্ধি ও ব্যাখ্যায় ডেকার্তে যেখানে দ্বৈতবাদী, স্পিনোজা সেখানে অদ্বৈতবাদী। ফলে ডেকার্তের কাছে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল কেবলমাত্র ঈশ্বর। ডেকার্তের উল্লিখিত চিন্তা ও ব্যাপ্তিকে স্পনোজা দেখিয়েছেন ঈশ্বরের লক্ষণ হিসেবে। এর মানে এই নয় যে, ঈশ্বরের লক্ষণ আর নেই। অগণিত লক্ষণ আছে তার। কিন্তু মানুষ জানে এই দুটিকেই। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) রূহ বা আত্মাকে দেখেছেন একটা লাইট বা জ্যোতিস্বরূপ, সেই জ্যোর্তিম্ময় অস্তিত্বই শক্তি (the energy)। মানবরূহটা জ্যোর্তিম্ময়ের কাছ থেকে তাঁরই একটি অংশ অর্থাৎ এক ধারণা থেকে আরো অন্য অনেক ধারণার সৃষ্টি যেমন- এক ঈশ্বর নিজে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। এই কথার সাথে স্পিনোজা অদ্বৈতবাদ ও ডেকার্তের দ্বৈতবাদ (বস্তুগত) এক হয়ে মিশে থাকে। স্পিনোজা যেখানে এই জগতে সংসারকে উপভোগ্য করে তুলে এই পার্থিব জগতকেই ঈশ্বরের একমাত্র আবাস ভূমি বলেছেন, সেখানে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) সংসারের আসক্তিকে দমন করে ঈশ্বরের প্রেমে নিমজ্জিত হতে বলে এক অতি প্রাকৃতস্তরে নিজের উন্নীত করার মধ্যদিয়ে মানবজনমের সার্থকতা খুঁজতে চেয়েছেন বা বলেছেন। প্রকৃতিতে ঈশ্বর যে প্রেম ছড়িয়ে রেখেছেন, সৃষ্টির মাঝে সেই প্রেমকে অবলোকনের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। নীরবতা প্রকৃতির ভাষা আর নীরবতায় নিমজ্জিত হয়ে সেই প্রকৃতির ভাষাকে আয়ত্ত করে তিনি নিজেকে প্রেমময়ের কাছে সোপর্দ এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বস্তুজগতের ব্যাখ্যাদানকারী দার্শনিকগণ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁরা কেবল সৃষ্টিকর্তার লক্ষণকে ধরেছেন। এই ক্ষেত্রে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে সৃষ্টিকর্তায়লীন হয়েছেন। তাই তাঁর জীবনের অন্যতম দর্শন ছিল ‘সৃষ্টির সেবা আর স্রষ্টার ইবাদাত’ বিংশ শতাব্দীর এই মহান পুরুষের স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত