আমাদের মহামারি বায়ুদূষণ, মুক্তি মিলবে কবে!

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে অন্যান্য আলোচিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক বাতাস দূষণ সাম্প্রতিক সময়ে অতি আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন মরণব্যাধি রোগের চেয়েও বায়ুদূষণ আমাদের অধিক ভাবনায় রাখছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোট ২৪ দিন ঢাকার বাতাস ছিল বিপজ্জনক, ফেব্রুয়ারিতেও এই অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। এমনকি ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের দূষিত বাতাসের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছয় নম্বরে উঠে আসে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একিউআই প্রদানকৃত এক বার্তায় দেখা যায় ঢাকার স্কোর ১৭০, যা অস্বাস্থ্যকর হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তবে কে বলবে, এই দূষিত বায়ু আমাদের অসংখ্য রোগের কারণ। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাতাস। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে বাতাস তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে। অথচ জীবনধারণের জন্য বায়ু অত্যাবশ্যক। বায়ু না থাকলে পৃথিবী শূন্যতায় পর্যবসিত হতো। অন্যান্য দূষণের চেয়ে বায়ুদূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ বাতাস স্বল্প সময়ে দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। এই অতিরিক্ত বায়ু দূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর।

যেসব জেলায় বায়ুদূষণ বেশির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং সমন্বয়হীন সংস্কার কাজ। গবেষক দল তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছেন যে, এমন অনিয়মিত এবং অনিয়ন্ত্রিত কর্মযজ্ঞ চলমান থাকায় এবং আশপাশের প্রায় ১২০০ ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প-কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো সেখানকার দূষণের অন্যতম কারণ। আবার যেসব অঞ্চলে বায়ুদূষণ কম সেখানে গবেষকরা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রাস্তাঘাটে জ্বালানি তেলে চালিত যানবাহনের সংখ্যা এবং ইটেরভাটা কম থাকাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় প্রথম দিকে থাকছে। আর রাজধানী ঢাকা থাকছে শীর্ষ দূষিত নগরীর তালিকায়। বিষয়টি আমাদের জন্য যতটা অসম্মানের তার থেকেও বেশি আশঙ্কাজনক। কারণ এই দূষিত নগরী এবং দেশের প্রতিটি বালুকণা এখন নানা রোগের ধারক বাহক হয়ে উঠেছে। যেখানে বায়ুর মান খারাপের ফলে জনস্বাস্থ্য যে চরম ক্ষতির মুখে, তা বলা বাহুল্য। অন্যদিকে জাতিগত ভাবমূর্তির বিষয়টি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা বিশ্বের কাছেই আমাদের দূষিত নগরের বার্তা পৌঁছে গেছে। আগেকার দিনে বাংলাদেশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল এখানে বন্যা, দারিদ্র্যের চরম দুর্ভাগ্য এবং অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি। তবে গত কয়েক দশকে তৈরি পোশাকসহ শিল্পের নানা খাতে এবং সামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ আশাতীত উন্নতি করেছে। এতে দেশের সুনাম বেড়েছে। তবে বছরের পর বছর যদি দূষণের মাত্রা বাড়তেই থাকে, তাহলে উন্নতি ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। এতে অন্য দেশের মানুষ আমাদের এখানে আসতে নিরুৎসাহিত হবে। দেশে বিনিয়োগ কমবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

তাই বায়ুদূষণকে নিছক পরিবেশগত ইস্যু হিসেবে দেখলে হবে না। এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সরাসরি সম্পর্ক আছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ু দূষণে ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। দূষণের কারণে বাড়ছে মানুষের বিষণ্ণতাও যার অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির চার ভাগেরও বেশি। বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। মারাত্মক এমন বায়ুদূষণ মানুষের শরীরে বিস্তার প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন রোগেরও কারণ হতে পারে। যার মধ্যে ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ অন্যতম। এছাড়া কিডনির ওপরেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বায়ুদূষণ। এমনকি রক্তচাপ, প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি, চোখ ও ফুসফুসের সমস্যা, ক্যান্সার ও হৃদরোগেরও অন্যতম কারণ হতে পারে বায়দূষণ।

সংক্রামিত রোগগুলোর পেছনে বায়ুদূষণ অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে।

সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই গবেষণায় বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইপিআইসি এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স নির্ণয়ে গবেষকরা বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা হিসাব করতে স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন।

বায়ুদূষণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণযুক্ত পরিবেশে কোনো শিশু বেড়ে উঠলে তার গড় আয়ু ৩০ মাস (২ দশমিক ৫ বছর) পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। মৃত্যুঝুঁকির অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ অধিকতর দায়ী। বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২ দশমিক ৫ (২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যাসের বস্তুকণা)। এশিয়ায় বায়ুর গুণমান অনেক খারাপ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৯০ সাল থেকে পিএম ২ দশমিক ৫ মাত্রার মধ্যে বসবাস করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে মানুষের তৎক্ষণাৎ বা দ্রুত মৃত্যু হয় না। বরং এটা একধরনের নীরব ঘাতক। মানুষের মৃত্যুর ১০টি কারণের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে এই বায়ুদূষণ। গত ৩০ বছরে পানি ও পয়োনিষ্কাশনজনিত মৃত্যুহার কমলেও বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুহার বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বায়ুদূষণের কারণে দেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে, বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।

বায়ুদূষণের ফলে মানবস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে সন্দেহাতীতভাবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার বিপুল সংখ্যক অধিবাসী দূষিত পরিবেশ এবং শব্দদূষণের কাছে জিম্মি। তাই কীভাবে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ দূর করা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

শিল্পাঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, ধাতব কণা, ধোঁয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে।

কাজেই এখন সময় এসেছে দ্রুত বায়ুদূষণের করালগ্রাস থেকে দেশকে রক্ষা করার। এর জন্য বেশকিছু পরিকল্পিত উদ্যোগের প্রয়োজন আছে।

প্রথমত, যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানির (পেট্রল ও ডিজেল) দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনোক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এছাড়া যানবাহনের ধোঁয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেন অক্সাইড থাকে যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে। এই নীরব ঘাতক কালো ধোঁয়া রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে।

অসচেতনায় বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখতে পাই রাস্তার ধারে কিংবা নালায় মরা জীবজন্তু কিংবা উচ্ছিষ্ট পড়ে থাকে। যদি নির্দিষ্ট স্থানে এসব মরা পশু কিংবা জীবজন্তুর উচ্ছিষ্ট মাটিচাপা দেয়া যেত, তাহলে এই অসম্ভব যাতনা সহ্য করতে হতো না। কারণ মৃত জীবদেহের পচনের ফলে অনেক ধরণের দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুদূষণ ঘটায়। এজন্য আশপাশে জীবজন্তু মারা গেলে তা মাটিচাপা দিয়ে রাখার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

শুষ্ক ঋতুতে অনেকেই আবর্জনা সংগ্রহ করে তা পুড়িয়ে নষ্ট করেন। বিশেষ করে বনের শুকনো পাতা এভাবে নষ্ট করা হয়। এ থেকে তৈরি ধোঁয়া পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

এছাড়া ধূমপান বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। যতদূর সম্ভব নির্দিষ্ট বিধান বাস্তবায়ন তৈরি এবং সেটির প্রয়োগ জরুরি। ধূমপানমুক্ত নগরী তৈরির প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এতে যেমন ধূমপায়ী নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রেহাই পাবেন তেমনি আশপাশের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

সর্বপরি বিভিন্ন রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অন্যান্য নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। অর্থাৎ বায়ুদূষণ রোধে যত প্রকার ব্যবস্থা রয়েছে, তার সবগুলো সরকার কর্তৃক শিগগিরই বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের মাঝে এ সংক্রান্ত ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। তবেই বায়ুদূষণের মতো ভয়াবহ মহামারি থেকে আমাদের মুক্তি সম্ভব।

লেখক পরিচিতি : সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।