ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কৃষিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল

এস এম মুকুল
কৃষিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল

করোনার লকডাউনের ফলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানের ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব খুব বেশি না থাকলেও কৃষির অন্য ক্ষেত্র যেমন- সবজি, ফল, ফুল, মাছ, গবাদিপশু-পাখি ইত্যাদি চাষাবাদ বা পালনে করোনাকালের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। ডেভরেসোন্যান্সলি’র গবেষণায় ৯০ শতাংশ কৃষক বলেছেন, করোনার কারণে তাদের কৃষি ক্ষতির মুখে পড়েছে। ৭৮ শতাংশ কৃষক তাদের উৎপাদিত সবজি, মাছ, দুধ, ডিম, এমনকি পোলট্রি বাজারজাত করতে সমস্যায় পড়েছেন। পরিবহন ও হাট-বাজার সীমিত হওয়ায়, খুব কমই বাজারে নিতে পারছেন। ৩৮ শতাংশ কৃষক বলেছেন বাজরে যতটুকু কৃষিপণ্য যাচ্ছে, তার সঠিক দামও পাচ্ছেন না এমনকি বিক্রিও হচ্ছে না। বেগুন, শসা, শিম ও আলুর মতো সবজি বিক্রিতে কৃষককে সবচেয়ে বেশি লোকসান গুণতে হয়েছে। এ গবেষণায় করোনার কারণে কৃষকের পরিবার প্রতি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৫৩ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ। এ ছাড়া, সম্ভাব্য ক্ষতির ক্ষেত্রগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, বাজার এবং পণ্য-সরবরাহ বা যোগাযোগব্যবস্থা পূর্ণরূপে সচল হতে যদি আরো ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে, তাহলে শুধু কৃষি খাতে পরিবার প্রতি সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে গড়ে ৭৩ হাজার ১০০ টাকা, যা তাদের পরিবারের বার্ষিক আয়ের ৩৯ শতাংশ।

করোনাকালের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যেও কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন একথা আবারো প্রমাণ করল। একইসঙ্গে আবারো প্রমাণ হলো- কৃষকরাই বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। কেননা, করোনাকালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ছাত্র-শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন লকডাউনে ঘরবন্দি, তখনো মাঠে তৎপর ছিলেন বাংলার কৃষকরা। করোনার ঝুঁকি নিয়েও তারা দিন রাত খেটে ফলিয়েছেন সোনার ফসল। বলতে দ্বিধা নেই কৃষকের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দি ১৭ কোটি মানুষের জীবন। করোনায় সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও কৃষকরাই সচল রেখেছেন দেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশ্লেষণ বলছে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরবন্দি মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে তার অধিকাংশই ছিল কৃষিপণ্য। করোনাকালে লকডাউনের সময় পরিবহন, হাট-বাজার সবকিছু ছিল বন্ধ থাকা আর ক্রেতারা গৃহবন্দি থাকায় কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। করোনার ক্ষতির মধ্যে এসেছে বন্যার দীর্ঘ স্থায়িত্ব। এরফলেও কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও কৃষকরা দমে যাননি। নিবিষ্ট মনে বাংলার কৃষকরা উৎপাদনে নেমেছেন ফসলের মাঠে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশের কৃষি খাতের এই অবদান আবারও মনে করিয়ে দিয়ে গেছে, ‘কৃষিই আসল ভরসা’। এখন বিশ্বমন্দার পরিস্থিতিতে সারাবিশ্ব খাদ্যসংকটের আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন, সাশ্রয়ী ও মিতব্যয়ী হতে বলেছেন। তিনি দুঃসময় মোকাবিলায় উৎপাদন বাড়ানোর কথাও বলেছেন। আমরা বিশ্বাস করি সরকার যদি কৃষকদের সর্বোচ্চ সহায়তা নিশ্চিত করে, তাহলে দেশে খাদ্যসংকট হবে না। আর দেশের আপামর জনগণ যদি সচেতনভাবে অপচয় পরিহার করে সাশ্রয়ী ভূমিকা নেয়, তাহলে বাংলাদেশ খাদ্যসংকটসহ মন্দা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও এড়িয়ে যেতে পারবে।

কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো- দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। আমরা জানি, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্সের ওপর। এদের মধ্যে তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স উঠানামা করে। তবে কৃষি অনেকটাই স্থায়ী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষি কোনো না কোনোভাবে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাধীনতার আগে দেশে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন চাহিদায় হিমশিম খেতে হতো, অথচ স্বাধীনতার চার দশক পর ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটাতে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা। উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা ডেভরেসোন্যান্সলি’র গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কৃষকরা তাদের কৃষি-জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসলও ফলিয়ে থাকেন। জমিতে কোনো না কোনো সবজির চাষ করেন ৭৮ শতাংশ কৃষক। ২৬ শতাংশ কৃষক জমিতে পাট চাষ করেন। ১২ শতাংশ কৃষক জমিতে মাছের চাষ করেন, প্রায় সমপরিমাণ কৃষক সরিষা, ডাল এবং রসুন উৎপাদন করেন। বাদাম এবং সয়াবিন উৎপাদন করেন ১০ শতাংশ কৃষক। ভুট্টা চাষ করেন পাঁচ শতাংশ কৃষক। আম চাষ করেন চার শতাংশ কৃষক। পেঁয়াজ চাষ করেন চার শতাংশ কৃষক। তিল চাষ করেন তিন শতাংশ কৃষক। পান উৎপাদন করেন তিন শতাংশ কৃষক এবং এ ছাড়া কিছু কৃষক তাদের জমিতে অন্যান্য ফল ও ফুলেরও চাষ করেন। তবে ১২ শতাংশ কৃষক ধান ছাড়া অন্য কোনো কৃষিজ কাজে তাদের জমি ব্যবহার করেন না। করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার বাণী শুনিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে। এত দিন চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত