ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার

বার বার আশার বাণী শুনতে চায় না মানুষ
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার

১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বিদেশে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চৌধুরী মাইন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে ফেরত আনার চেষ্টা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত রোববার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন এই আশার বাণী শোনালেন। তিনি জানালেন পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী এই জঘন্য কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা চৌধুরী মাইন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে দেশে তারা আছেন ওই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সেই সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চৌধুরী মাইন উদ্দিন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ৯ মাস ধরে যে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছিল, ধারণা করা হয় তার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী। যদিও পরবর্তীতে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পর রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল। তবে ইতিহাসবিদের বক্তব্য, বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করার জন্য রীতিমত নির্দেশনা দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি। অবশ্য ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা এমন কথাও বলেছেন যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি, ফলে এসব তথ্য সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। যুদ্ধের পুরো নয় মাস ধরে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হলেও ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় দিবসের দিন কয়েক আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীদের শেষ আঘাতটি ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে ধরে হত্যাকাণ্ড। যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন তাদের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা। হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল আলবদর বাহিনী। ১৪ই ডিসেম্বর রাতে একযোগে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায় ১৪৯ জন। ইতিহাসবিদরা বলেছেন, সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা না করে যদি জনসংখ্যা আর মৃত্যুর হার হিসেবে হিসাব করা হয়, তাহলে ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতে অন্যান্য আরো বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন কিন্তু তাদের আসলে সেভাবে স্মরণ করা হয় না। বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, আলবদর বাহিনী জড়িত থাকলেও পরিকল্পনাটি কে, কখন কীভাবে করেছে; সেটা এখনো গবেষকদের কাছে পরিষ্কার নয়। ২৫শে মার্চ রাত থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী- সারা দেশের শহরে এবং গ্রামে তাদের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আলবদর বাহিনী গঠিত হওয়ার আগেই বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংঘ পুরোপুরি আলবদরে রূপান্তরিত হয়। তাদের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ঢাকা শহরে আলবদররাই মাইক্রোবাসে করে সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসের প্রাক্কালে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে একটি ধোঁয়াশা বক্তব্য দেন। ডিসেম্বর মাস এলে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যকাণ্ডের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন। অথচ বছরের অন্য সময়ে বিষয়টি নিয়ে কোনো কাজ করা হলে স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাধিক বছর পরও নতুন করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচাররের দাবি কেউ করতেন না। যেসব বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন, তাদের সন্তানরা বেঁচে আছেন। তারা প্রতি বছর এই দিবসটি এলেই বিচারের দাবি জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও দুয়েক দিন নড়েচড়ে বসে। কেতাবি ঢংয়ে একটি বক্তব্য দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করে। সব কিছু নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সামনে আনা কাম্য হতে পারে না। মানুষ আর কত দিন বুদ্বিজীবীদের হত্যার বিচার চাইবে। বুদ্বিজীবীদের সন্তানরাই যে কেবল বিচার চাইবে তাই-ই বা কেন হবে। যেসব বুদ্বিজীবী আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দেয়ার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য হলেও তাদের হত্যাকাণ্ডের বিচার অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রকে এগিয়ে অসতে হবে। বুদ্বিজীবীদের হত্যাকারী, তাদের সহযোগীরা এখনো যারা বেঁচে আসে তাদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। আর অপেক্ষার অবকাশ নেই। মানুষ বার বার আশার বাণী শুনতে চায় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত