ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

অলোক আচার্য
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

বহু বছর ধরেই পৃথিবী বিকল্প শক্তির সন্ধানে হন্য হয়ে ছুটছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। এক. জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমিয়ে আনা এবং দুই. শক্তির বিভিন্ন উপাদানের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প জ্বালানির ব্যবহারে যাওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই মুহূর্তে টের পাচ্ছে। এবারের কপ-২৮ সম্মেলনেও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু তেল নির্ভর দেশের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ, তাদের অর্থনীতিই তেল নির্ভর। বিশ্বের তেলের জোগানের একটি বড় অংশই আসে এসব দেশ থেকে। যদিও একটা বিষয়ে এখন পুরো বিশ্ব একমত যে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে।

এমনকি সেই সব দেশও বিষয়টি স্বীকার করে। সক্ষমতার ৮৩ শতাংশই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে এসেছে। আগের বছর এই হার ছিল ৮১ শতাংশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে এশিয়ার দেশগুলো এগিয়ে আছে। যেমন- ২০২২ সালে চীন নবায়নযোগ্য খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে ১৪১ গিগাওয়াট। একই বছরে ভারত উৎপাদন করেছে ১৫ দশমিক ৭ গিগাওয়াট। এর ফলে আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে ব্যাপক। যেমন- নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করায় ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে তেল কম আমদানিতে আগের বছরের চেয়ে ভারতের ৪২০ কোটি ডলার ব্যয় কম হয়েছে।

বাংলাদেশের ন্যাশনাল রিনিউবেল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) আগেই জানিয়েছে যে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চল বায়ুবিদ্যুৎ বা উইন্ড মিল স্থাপনের জন্য উপযোগী। এনআরইএলের প্রাথমিক মূল্যায়ন থেকে আরো জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তত ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে, যেখানে বাতাসের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৫ দশমিক ৭৫ থকে ৭ দশমিক ৭৫ মিটার। এটা উইন্ডমিল চলার জন্য উপযোগী।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সিরাজগঞ্জ সোলার পার্ক প্রকল্পের পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (পিপিএ) এবং ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ) স্বাক্ষর হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এ সময় জানানো হয়, এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এর কিছুদিন পর সৌর বিদ্যুতের সম্প্রসারণে ইন্টারন্যাশনাল সোলার এলায়েন্স (আইএসএ)-এর সঙ্গে কান্ট্রি পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় সৌরবিদ্যুতের সহযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। এর মাধ্যমে একটি সোলার রোডম্যাপ (২০২০-২০৪১) তৈরি হবে। তথ্যে জানা যায়, সরকারের নেয়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা তেরখাদায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদুৎকেন্দ্র, চুয়াডাঙায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৪২ মেগাওয়াট বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৭০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদুৎকেন্দ্র, জামালপুরে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, জামালপুরে ৮৫২ কিলোওয়াট রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, সিলেটে ১০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, পঞ্চগড়ে ৫০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, চাঁদপুরে ৭ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নীলফামারীর ডিমলায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ২০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, ধামরাইয়ে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জে ৬ মেগাওয়াট বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। এসব প্রকল্প থেকে আগামী ২০২৪ সালের জুন নাগাদ সুফল পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৯১০.৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলমান রয়েছে আরো অন্তত ৩২টি প্রকল্পের কাজ, যা থেকে পাওয়া যাবে ১ হাজার ৪৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। শুধু তাই নয়, প্রক্রিয়াধীন থাকা আরো ৭৬টি প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদন হবে প্রায় ৪ হাজার ৬৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর পাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে নেপালের জলবিদ্যুতেরও। ফলে দেশে চলমান বিদ্যুৎ সংকট কাটতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো জন্য প্রয়োজন হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই উৎপাদনের অর্ধেক অর্থাৎ ২ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে। পানি ও বায়ুর ব্যবহার করে উৎপাদন হবে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যা সর্বমোট সক্ষমতার প্রায় ৩ শতাংশ। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা রোধ করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার মতো কার্যকর আর কোনো পদক্ষেপ নেই। কারণ এর ফলে পরিবেশে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত গ্যাস নির্গত হওয়া কমবে, পরিবেশ উষ্ণ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে এবং বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশ যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা রক্ষা পাবে।

অনবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন তা নিঃশেষ হয়ে আসছে, অন্যদিকে সভ্যতা গভীর সংকটে উপনীত হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি যা ব্যবহারের ফলে নিঃশেষ হবেই এবং প্রকৃতিতে আর ফেরত আনা সম্ভব না। এটাই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। এছাড়া তেল, গ্যাস বা কয়লার মতো জ্বালানি কোনো দেশে অধিক বা কম পরিমাণে মজুত থাকে, যা পৃথিবীতে অশান্তির একটি কারণ হয়ে উঠতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও বেড়েছে বহুগুণে বেশি। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ সম্পদ প্রায় শেষের দিকে। আমাদের দেশেও একই অবস্থা। বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কলকারখানার জন্য ব্যবহৃত শক্তির একটি বড় উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাই ভবিষ্যৎ জ্বালানির চিন্তা করতেই হচ্ছে। ভবিষ্যতের পৃথিবী কোন উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন করবে? অনবায়ন শক্তির বিপরীতে রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি। ব্যাপকহারে না হলেও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার সারা পৃথিবীতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে শক্তির ঘাটতি পূরণে। উৎপাদন, গাড়ি ও অন্যান্য যন্ত্র চালনা; এমনকি উড়োজাহাজ, বিদ্যুৎ উৎপাদন- সব ক্ষেত্রেই নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যতের জ্বালানি ঘাটতির কথা বিবেচনা করেই এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে প্রথম পছন্দ হলো সৌরশক্তি, যা থেকে মানবজাতি যুগ যুগ শক্তি উৎপাদন করতে পারবে এবং নিঃশেষ হবে না। সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে আমেরিকা, চীন, জাপান, জার্মানি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার অনেক এগিয়ে। প্রতিটি দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তি হিসেবে সৌরশক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করছে। সৌরশক্তি ছাড়াও পানি, বাতাস কাজে লাগিয়েও শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে এবং তা ব্যবহারও হচ্ছে। আমাদের দেশেও সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং তার অগ্রগতি আজ বহুদূর।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন যে শক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিভিন্ন উন্নত দেশ নিজেদের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এতে উভয় দিকেই সুবিধা রয়েছে। অনবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কমার সাথে সাথে নগরের সমস্যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনারও সঠিক সমাধান হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বিধায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন একটি অন্যতম মাধ্যম। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি ব্যবহার করে উন্নত দেশগুলো আজ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে, যা এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ বাস্তবায়ন করছে। এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির পর যে এই গতি আরো দ্রুত হবে অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ জ্বালানিতে স্বনির্ভর হতে চাইবে তা বলাই বাহুল্য। এর একমাত্র উপায় হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা। এর ফলে একদিকে যেমন বিশ্ব বসবাসের উপযোগী হবে অন্যদিকে শক্তি অফুরন্ত উৎসের ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক জীবন নিশ্চিত হবে। সেই সাথে জ্বালানি সংকটে বর্তমানের পরিস্থিতি তৈরি হবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত