বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং আমাদের নতুন প্রজন্ম

শফিকুল ইসলাম খোকন, কলাম লেখক

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যে কোনো সহিংসতা, হত্যা সামাজিক, আইন ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ। সমাজে কিছু কিছু অপরাধ মেনে নেয়া যায় না। কিছু কিছু ইতিহাস সমাজের মানুষ ভুলতে পারে না, কোনো কোনো ইতিহাস মানুষ মনে রাখে কষ্ট হিসেবে, কিছু ইতিহাস মনে রাখে আনন্দ হিসেবে। আবার কিছু ইতিহাস আছে গোটা জাতিকে কাঁদিয়ে রাখে। এমন একটি ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা। যার মধ্যে হৃদয়বিদারক ইতিহাস বুদ্ধিজীবী হত্যা। ইতিহাসের ঘটনা যখন সংগঠিত হয়, তখন যে প্রজন্ম থাকে ওই প্রজন্ম মৃত্যু হলে বা ক্ষমতার পরিবর্তন পরবর্তী সময়ে প্রজন্ম কি জানবে? বর্তমান প্রজন্মের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় বুদ্ধিজীবী কারা, বুদ্ধিজীবীদের কবে হত্যা করা হয়েছে? বুদ্ধিজীবী দিবস কবে? তার উত্তর কি দিবে...? আমার বিশ্বাস অধিকাংশ বর্তমান প্রজন্মরা সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। আমাদের দেশে অনেক ইতিহাস রয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু ইতিহাস যুগ যুগ ধরে জাতিকে কাঁদায়। ডিসেম্বরে মহান বিজয় অর্জনের কারণে আমরা একদিকে যেমন- আনন্দণ্ডউচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হই; একইসঙ্গে এই মাস আমাদের কাছে বেদনাবিধুরও বটে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসপর্ণের মাধ্যমে আমাদের মহান বিজয় শুরু। ঠিক তার দুদিন আগে এ দেশের রাজাকার, আলবদর, আলশামস হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমাদের দেশের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মাত্র কয়েকটি রাষ্ট্র যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের দেশকে স্বাধীন করেছে। বাংলাদেশ সেদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে। কারণ, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে বাঙালি জাতির। যদিও বিশ্বের মানচিত্রে খুব ক্ষুদ্র একটা দেশ এটা, দেশটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বলা হয় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ কিন্তু আমাদের সংগ্রামের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। আমাদের স্বাধীনতা জীবন দিয়ে কেনা; একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও সমাপ্তিলগ্নে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন অনেক দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সঙ্গে একসঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় চলে আসার প্রাক্কালে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে জাতিকে মেধাশূন্য করতে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা সাজায় হানাদার বাহিনী। ৪ ডিসেম্বর হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ১০ ডিসেম্বর হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুত হতে থাকে। তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বহু গুণিজনকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বিজয়ের মধ্যদিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। প্রতিবছর গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬জন শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীরা তাদের নিজ নিজ পেশায় ছিলেন আলোকবর্তিকা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশগড়ায় তারা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারতেন। দেশ গঠনে তরুণ-যুবাদের নতুন উদ্যমে তৈরি করতে পরামর্শ দিতে পারতেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এবং তাদের অভাব বঙ্গবন্ধুর মনে কতটা ক্ষত তৈরি করেছিল, তা অনুমান করা যায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ভাষায় ও আবেগে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু আবেগঘনভাবে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি, শহিদদের স্বজনদের ধরে অঝোরে কেঁদেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর আল-বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দু’টি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আল-বদর বাহিনী আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আল-বদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান (লাডু ভাই), এএনএম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরো অনেকে। একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ২০১৬ সালের ১১ মে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের তো ফাঁসির দণ্ড হয়েছে, আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি। আমরা কলঙ্কমুক্ত হলেও জাতি কি বুদ্ধিজীবীদের মনে রাখছে? স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসেও এমন প্রশ্ন মনে জাগে; কথায় আছে ইতিহাস দিয়ে মানুষ অনেক শিক্ষা নেয়; কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রজন্ম সেই ইতিহাস লালন তো করেই না, ইতিহাস জানার বিষয়ও তেমন আগ্রহও নেই। আসলে এসব ইতিহাসের কথা শুধু লেখাই হয়, কতজনে মনে রাখে? বর্তমান প্রজন্মের মনে রাখার কোনো উপায় দেখছি না। তারা মোবাইলের যুগে এসে সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা, জেল হত্যা দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসের কথা এখন তাদের কাছে নতুন; তাদের কাছে এমন ইতিহাস জানতে চাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। অথচ দেশের নাগরিক হিসেবে সবার জানা দরকার। সরকারের যেমন জনগণের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি জনগণের দেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। একসঙ্গে এতো বুদ্ধিজীবী হত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আমি মনে করি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পচাত্তরের কালো রাত, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ নানা ইতিহাস রয়েছে যা নতুন প্রজন্মকে জানাতে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যদিও বর্তমান সরকারের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার করা হয়েছে। এগুলো কতটুকু যথাযথ ব্যবহার করা হচ্ছে তাও দেখা দরকার। পাশাপাশি শুধু দিবসেই নয়, প্রতিদিন বিদ্যালয়ে ক্লাসে অন্তত একটি ক্লাস মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, ’৭৫-এর কালো রাত, বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ যতগুলো ইতিহাস রয়েছে তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ানো। তাহলে বর্তমান প্রজন্ম কেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মরাও ভুলবে না। পরিশেষে বলছি, এ দেশ আমাদের, এ দেশ জীবন দিয়ে কেনা, এ দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন করা হয়েছে। বিশেষ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এবং পরিবারের সন্তানদের প্রতি জাতির তথা আমাদের কর্তব্য রয়েছে। তারা যাতে উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাদের ত্যাগ বৃথা যায়নি। আজও বর্তমান প্রজন্ম তা মনে রেখেছে। যারা বাংলাদেশ পরিচালনা করছেন, প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি নেই; আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দেশকে রক্ষা করি, এ দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছে, তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।