ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির ঋণ

পরিবারের সদস্যদের দিতে হবে যথাযথ মর্যাদা
বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির ঋণ

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির বেদনাবিধুর শোকের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই এ বাংলার কৃতি সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা সম্ভাবনাময় জাতিকে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য নীলনকশা বাস্তবায়নে নেমেছিল নরপশু ঘাতকরা। বুদ্ধিজীবী হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্যাতন ছিল পাশবিক, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। শুধু বুলেটের আঘাতেই নয়, বিষাক্ত বেয়নেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে হত্যা করা হয়েছিল সোনার বাংলার অহংকার মেধাবী সন্তানদের, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ঘৃণ্যতম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ দেশীয় দোসরদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। জেনারেল রাও ফরমান আলীর মূল পরিকল্পনা ছিল বুদ্ধিজীবীদের একত্রে আমন্ত্রণ করে একস্থানে একই সময়ে হত্যা করা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয়ের অশুভ সন্ধিক্ষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার সহচর বিশেষ করে আলবদর, আলশামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যাকে যখন যেখানে পেয়েছে, সেখান থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীগণ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় বাছাই করে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে।

এছাড়া যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানের পরাজয় যখন শুধুই সময়ের ব্যাপার, ঠিক তখনই বাঙালি জাতি যেন শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তারই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হানাদার বাহিনী এবং তার দোসররা নিতে ভুল করেনি। তাই তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার লক্ষ্যে তালিকা তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এখন পর্যন্ত ৪২টি মামলায় ১০৩ জনের বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। বিচারাধীন আছে ৩৮টি মামলা, যার আসামি সংখ্যা ২৩২ জন। এছাড়া আপিলে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০টি মামলা। যার মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করা হয় জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে রায় দেয়। এ রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। আন্দোলনের মুখে আইন সংশোধন করে সাজা বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ওই আপিলের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল তাদের বিচার আজও বাংলার মাটিতে হয়নি। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার এখন সময়ের দাবি। টার্গেট করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এবং একত্রে এত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এটি জাতিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পঙ্গু করে দেওয়ার এক নির্মম নীল-নকশা। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং এর দোসররা শুধু জেনেভা কনভেনশনের নীতিমালাই লঙ্ঘন করেনি, নিরীহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বিশ্বের বুকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি জঘন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, যার বিচার অদ্যাবধি হয়নি। যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিচার পৃথিবীর সব দেশে বিদ্যমান থাকলেও অদৃশ্য কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার সাহায্যকারীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং অটল সিদ্ধান্তের কারণে এ দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার সীমিত আকারে হলেও হয়েছে, যা সমগ্র বিশ্বের বুকে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের বিচার আজো বাংলার মাটিতে হয়নি। আর সেই বিচার কখন শুরু হবে, তা কেউ জানে না।

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্রকারী এবং তার দোসরদের মরণোত্তর বিচারের দাবি থেকে সরে আসার কোনো কারণ নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ অবধি যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তা, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে নিহত কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী। যারা নিখোঁজ হয়েছেন, এ বিষয়ে কমিশন গঠন করে প্রকৃত নিখোঁজের রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি রাখে। তাছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরূপ রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাতা প্রদান করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতি ঋণী। আর সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের প্রতি যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত