রক্ত দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতা

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে- ‘কখন আসবে কবি?’ এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকাল সেদিন ছিল না। তা হলে কেমন ছিল সেদিনের বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকালের বিরুদ্ধে বিকাল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...।’ স্বাধীনতা আসলে একটি স্বপ্ন। প্রতিটি পরাধীন মানুষের চোখে প্রথম স্বপ্ন থাকে একখণ্ড স্বাধীন ভূমির, একটি নিজস্ব পতাকার এবং নিজস্ব ভাষার অধিকার। পরাধীনতা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়। পৃথিবীতে বহু জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধ করেছে এবং আজও করছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে বহু দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের যৌবন, কিশোর বেলা ছিল স্বাধীনতার জন্য। তারপর পশ্চিম পাকিস্তানের শ্যেন দৃষ্টি থেকে মুক্ত করে পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। পেয়েছি লাল, সবুজ পতাকা। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে এঁকে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ংকর ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা। নির্মম বা নৃশংস কোনো শব্দই এই নির্মমতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। একদিন পৃথিবীতে আমাদের সেই বীর মানুষ থাকবেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের হারিয়ে ফেলব। কিন্তু তাদের স্বপ্ন, তাদের দেখানো পথ আমাদের সামনে থাকবে। আমাদের মাঝেই তারা বেঁচে থাকবেন। স্বাধীনতা একটি স্পর্শমণি যা প্রত্যেকেই চায়। আমরাও চেয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম আর বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলাদেশে গণহত্যা বইতে সিডনির শৈল চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে জানিয়েছেন, ধর্ষিতা মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক ২ লাখ হলেও তার মতে এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন এই সংখ্যা ৪ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতো হতে পারে। তিনি আরো জানান, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যাত্ব বরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছে। অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। সুতরাং পরিবার পরিজনহীন একাকী জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এসব বীরাঙ্গনাকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। তাদের প্রাপ্য নিশ্চিত করতে হবে। যেসব মানুষ আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিতে জীবন বাজি রেখেছেন, তাদের কেউ কেউ আজো অবহেলিত। দেশকে ভালোবেসে যাওয়াই তাদের একমাত্র সান্ত¦না। কিন্তু তাদের জন্য কিছু না করতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা চাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যিনি এ দেশের জন্য রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি তার কর্মের স্বীকৃতি পাক। এসব মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তাকে তার সম্মান দেওয়া হোক। তাদের ঋণের শোধ না হলেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করাই যায়। ডিসেম্বর মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। আমাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতির মাস। এ মাসেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কবির ভাষায়, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে, বাঁচিতে চায়, দাসত্ব শৃঙ্খল কে পরিবে পায়, রে কে পরিবে পায়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী জন্ম থেকেই স্বাধীনতামুখী। প্রতিটি প্রাণী নিজ স্বাধীনতা অর্জনে বদ্ধপরিকর থাকে। আবার একশ্রেণির প্রাণী থাকে, যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করেই শান্তি পায়। একশ্রেণি শোষণকারী অপরদিকে থাকে শোষিত শ্রেণি। যারা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে। যুগ যুগ ধরে এটি হয়ে আসছে। শোষিত শ্রেণি যখনই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে, সংগ্রাম করে তখনই তাদের উপর নেমে আসে জুলুমকারীদের খড়গ। কিন্তু একথা ঠিক যে স্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ হয় তীব্র এবং তা সব বাধা ভেঙে দেয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির মরণপণ সংগ্রামের ফলেই এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এটা আমাদের চূড়ান্ত ত্যাগের প্রতীক। আমরা যারা এ প্রজন্মের তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি।