বিজয় দিবসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য

শেখর ভট্টাচার্য

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এই উপমহাদেশভুক্ত অন্য কোনো দেশে ‘বিজয় দিবস’ বলতে কোনো দিবস নেই। বাংলাদেশ ও বাঙালির ‘বিজয় দিবস’ তাই অনন্য। সমগ্র বিশ্বের কোনো জাতি এতো ‘দাম’ দিয়ে স্বাধীনতা বা মুক্তি সংগ্রামের বিজয় অর্জন করেনি। অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মোকাবিলা করে লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে এ বিজয় অর্জন করতে হয়েছে শুধুমাত্র বাঙালির। এই বিজয় কি শুধুমাত্র পাকিস্তানি শত্রুসেনার বিরুদ্ধে বিজয় ছিল? বিষয়টিকে এতো সরলভাবে দেখলে বিজয়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে অনুধাবন করা সহজ হবে না। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ৪৮ সালে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে। ভাষা ও সংস্কৃতি অবিচ্ছিন্ন। ভাষা, সংস্কৃতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। এ জাতীয়তাবোধ আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় বাঙালি জাতিকে। শুধু কি অসাম্প্রদায়িকতা? ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন জাতিকে নব্য ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ, মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে তুলে। এ কারণে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-সংস্কৃতি এবং সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে শহীদের রক্তস্নাত এক মহিমান্বিত বিজয়। বিজয় দিবসের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে। জানতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ হাতের লাঙ্গল, নৌকার বৈঠা, মাছ ধরার জাল ফেলে দিয়ে দুর্দমনীয় বীরে রূপান্তরিত হলো কীভাবে। আমি সারা বছর নিজেকে উজ্জীবিত করার জন্য একটি গ্রন্থ পাঠ করি। আর এ অমূল্য গ্রন্থটি হলো ‘একাত্তরের চিঠি’। রণাঙ্গন থেকে লেখা এই চিঠিগুলো যে কোনো পাঠক অনুভব করতে পারবেন, মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার জন্য প্রাণের আবেগ এবং আত্মত্যাগের ইতিহাস। ‘একাত্তরের চিঠি’ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের পত্র সংকলন। এই অমূল্য চিঠিগুলো সংকলিত করে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছিল ২০০৯ সালে। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ‘একাত্তরের চিঠি’ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা সেই চিঠিগুলো পাঠ করছিলাম। এই গ্রন্থটি আমার হাতের কাছে সব সময়ই থাকে। সামাজিক সংকীর্ণতা এবং দেশ-প্রেমহীন মানুষের অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে মন যখন কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে, তখন এই মহৎ গ্রন্থটি পাঠ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করি। এ গ্রন্থে যে সব মুক্তিযোদ্ধার চিঠি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন। প্রিয় পাঠক- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার শপথ এবং বাঁধভাঙা আবেগের অসামান্য অনুভূতিকে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে অনুভব করার জন্য রণাঙ্গন থেকে পাঠানো শহীদ জিন্নাত আলীর একটি চিঠি পাঠ করা আবশ্যক। চিঠিটি লেখা হয়েছিল ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৯ দিন পর। জিন্নাত আলী তার মাকে লিখছেন- ‘মা, আমার সালাম গ্রহণ করবেন। পর সংবাদ, আমি আপনাদের দোয়ায় এখনও পর্যন্ত ভালো আছি; কিন্তু কত দিন থাকতে পারব বলা যায় না। বাংলা মাকে বাঁচাতে যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেক জিন্নার প্রাণ দিতে হবে। দুঃখ করবেন না মা। আপনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি আপনার এই নগণ্য ছেলের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দিবে যে, বাঙালি এখনো মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।’ এরকম অসংখ্য চিঠি আছে এ অনন্য সাধারণ গ্রন্থটিতে। যে চিঠিগুলো পাঠ করলে গণসংগীত শিল্পী ও গীতিকার আবদুল লতিফের সেই অমর গানটির কথা মনে হয়- ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারো দানে পাওয়া নয়/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/জানা আছে জগৎময়/’। ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে যে বিজয় এসেছিল এই সুবর্ণভূমিতে, সেই বিজয় পতাকা যাদের রক্তে স্নাত হয়েছিল তারা হলেন আমাদের সশস্ত্র, নিরস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতাহীন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার জন্য তাদের প্রাণের আবেগ ছিল দুর্দমনীয়। সীমাহীন দেশপ্রেমকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মারণাস্ত্র দিয়ে দমন করা যায় না। একাত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ যুদ্ধবিদ্যায় সর্বোচ্চ পারদর্শী দেশগুলো ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষ। এসব দেশের আধুনিক মারণাস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁজর বিদীর্ণ করে ফেলার জন্য। নির্মম সত্য হচ্ছে- চীন, মার্কিনীদের মারণাস্ত্র এবং আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধ কৌশল পরাভূত হয় ‘ভীতু’ এবং ‘ভেতো’ বাঙালির সীমাহীন দেশপ্রেমের শক্তির কাছে। একাত্তরের চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অল্প শিক্ষিত তরুণ, কামার, কুমার, জেলে, কৃষক, মজুরসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মাতৃভূমির গ্লানী মোচনের জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার উদ্দেশ্যে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন মুক্তির জন্য যুদ্ধে। তাদের না ছিল যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষণ, না ছিল যুদ্ধের জন্য ন্যূনতম প্রস্তুতি। আধুনিক মারণাস্ত্র কতটা ভয়াবহ এ বিষয়ে কোনো ধারণা না নিয়েই তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রকৃত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তারা বুঝতে পারেন কী অসম যুদ্ধে তারা লিপ্ত হয়েছেন। যুদ্ধ যতই অসম হোক দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে তারা কোনো অবস্থাতেই পিছু হটে যাননি। তারা অসীম সাহসে বুক চিতিয়ে লড়াই করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে দেশের ডাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী থেকে পালিয়ে এসে, বিদ্রোহ করে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা যুদ্ধ করেছেন প্রশিক্ষণের প্রথা অনুযায়ী। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা দেশপ্রেমের আবেগকে যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করে আমরণ লড়াই করে গেছেন। লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা এই বাংলাদেশ, এই দেশটিকে কি আমরা শহীদের স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি? আমরা দেশ এবং জাতি হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করেছি; কিন্তু এই মহিমান্বিত বিজয়ের জন্য যে অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যহীনতা অর্জনের প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি। অর্জিত উন্নয়নের সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতার একটি বড় সম্পর্ক আছে। স্বাধীনতা ও সব মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদান করা না গেলে গাণিতিক উন্নয়ন হবে- এ কথাটি বলা যায় কিন্তু বৈষম্য হ্রাস করা কঠিন হবে। আধুনিক যুগে এ বিষয়টি নিয়ে সব চেয়ে উঁচু গলায় কথা বলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। উন্নয়ন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা যে পরস্পর সংযুক্ত, অমর্ত্য সেনের মতো আর কেউ এতো উচ্চকিত নন। এ কথাটি বঙ্গবন্ধু তার দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন বহু আগেই। এজন্য তিনি মানুষের মুক্তির প্রসঙ্গকে নিয়ে এসেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্নে। বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ দুটি শব্দকে দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। স্বাধীনতাকে তিনি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির অর্থে ব্যবহার করেছিলেন আর মুক্তি বলতে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনকে বুঝিয়েছিলেন। এ কারণে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বজ্ঞানে তিনি বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাই আমরা দেখে থাকি, খুব স্বাভাবিকভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে বৈষম্য নিরসন ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বিজয়ের ৫১ বছর অতিক্রম করার এ সময়ে আমরা হয়তো ‘স্বাধীনতার’ অনেক সুফল পেয়েছি। কিন্তু মুক্তির সংগ্রামের সুফল আমরা পাইনি বললেই চলে। মুক্তির সংগ্রাম এখনও চলমান। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করে বাংলাদেশ তেপ্পান্ন বছরে পা দিয়েছে। একান্ন বছর খুব কম সময় নয়। এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে রাষ্ট্রকে আরো মানবিক করে গড়ে তোলার আন্দোলনে; আর এ কাজটি করতে পারে সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ। মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেন তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতারা। যেমন বঙ্গবন্ধু উঠে এসছিলেন টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত গ্রাম থেকে। কতো ত্যাগ, দেশের প্রতি কতো ভালোবাসা, অঙ্গীকার, দায়বদ্ধতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি একজন মহান নেতা হতে পেরেছিলেন। যাকে অনন্তকাল বাংলাদেশ ও বাঙালি অনুসরণ করে যাবে। এরকম নেতার দেখা পাওয়ার জন্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে ‘শৌখিন’ রাজনীতিবিদদের হাত থেকে। রাজনীতিকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও সাধারণ মানুষের সহজ অংশগ্রহণসমৃদ্ধ। আমরা কি পারব তা করতে? পারতেই হবে আমাদের, কারণ সার্বিক মুক্তিই পারে- বিজয়ের আস্বাদ প্রদান করে প্রাণ-প্রাচুর্যময় একটি দেশ উপহার দিতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক