ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রিকশা ও রিকশাচিত্র

ইউনেস্কো কতকিছুই দেখে না

ফারুক আহমেদ
ইউনেস্কো কতকিছুই দেখে না

স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা একটা অসুখ। একজন শিল্পী যে অসুখে ভোগেন, তা এর থেকে আলাদা। শিল্পীর অসুখ সৃজনের, স্বীকৃতি পাওয়ার অসুখ তিনি লালন করেন না। রিকশাচিত্র ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর মনে হচ্ছে, এ শিল্পটা এতদিনে জাতে উঠল। এর আগে এটা ছিল কারিগরি দক্ষতার পর্যায়ের একটি মাধ্যম, এখন শিল্পের আসনে বসতে সক্ষম হলো। এত বছর ধরে রিকশাচিত্র-শিল্পীরা যে আর্থিক দীনতার ভেতর দিয়ে তাদের সৃজনকর্ম সাধন করে গেছেন। এই এক স্বীকৃতির পর বোধহয় তাদের আর এই আর্থিক টানাপড়েন থাকবে না। এ শিল্প রিকশার পেছন অংশ থেকে প্রদর্শনী হলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে অত্যুঙ্গ সম্মান ও মূল্য পরিধান করবে। আর এখন থেকে ধুলোমাখা পথের শিল্পীরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পীর সম্মান পাবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, রিকশাচিত্রের আগে ইউনেস্কো এ দেশে যেসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে তার মধ্যে আছে জামদানি বয়ন শিল্প, শীতলপাটি, বাউলগান, মঙ্গল শোভাযাত্রা। শিল্পের মতো শিল্পকলা বা সাহিত্যেরও একটি স্থানীয়করণ থাকে। প্রাচীন মিসরে কালো পাত্রের ওপর চিত্রাঙ্কনের যে দক্ষতা সে সময়ের শিল্পীরা অর্জন করেন, তা সমসাময়িক কোনো অঞ্চলের শিল্পীদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শাসকদের চাহিদাই প্রাচীন মিসরে এমন সৃজনশীল মৃৎপাত্র, অর্থাৎ একটি শিল্পমাধ্যম তৈরিতে সহায়তা করে। নোক ভাস্কর্যের শিল্পীদের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা চলে। আফ্রিকার নোক ভাস্কর্য শিল্পীদের এ কাজ অন্য কারো পক্ষে করা আর সম্ভব হয়নি। সে বিবেচনায় রিকশাচিত্রের মতো আমাদের আরো অনেক কাজই আছে, যা নিজস্ব। যেমন আমাদের টেপা পুতুল, যেন নোক ভাস্কর্যের খুব কাছের কোনো আত্মীয়। কিন্তু স্বকীয়, আলাদা। এরকম নানা শিল্প, ঐতিহ্যও স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। না পেলেও বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়। বরং ভেতরের শক্তি দিয়ে সে শিল্প তার সৃজনযাত্রা প্রবহমান রাখবে। এরকই হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। এখানে বলা প্রয়োজন, এ অর্জনকে খাটো করার জন্য এ লেখার অবতারণা নয়। বরং বলা যায়, প্রায় শত বছর ধরে চর্চিত শিল্পের একটা ধারার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলল। যে বাহনটি অন্য দেশ থেকে আমদানি হয়ে আমাদের নিজের হলো, সে বাহনে চর্চিত শিল্পমাধ্যমটি দেশের মানুষকে মুগ্ধ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পা ফেলতে সক্ষম হলো এ স্বীকৃতির মাধ্যমে। এমন একটা উপলক্ষ্যকে আমরা আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে বরণ করতে পারি।

এ শিল্প আন্তর্জাতিক বিপণনের ভেতর ঢুকে গিয়ে অমূল্য থেকে মূল্য (দাম) পাওয়ার একটি ক্ষেত্রও তৈরি করল। তার জন্যও আমাদের আনন্দিত হওয়া যেতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘের যে অঙ্গসংগঠনটি (মানে ইউনেস্কো) এসব সৃজনশীল ও ঐতিহ্যনির্ভর কাজের স্বীকৃতি দেয়, সেই সংস্থাটিকেও তো বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কেননা যেখানে রিকশাচিত্র স্বীকৃতি পেল অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে, সেখানে এমন অনেক বিষয় পড়ে আছে, যা ইউনেস্কোর নজরে আসছে না। খুব বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, সাহিত্যের শহর হিসেবে ইউনেস্কোর যে নেটওয়ার্ক, সেখানে মোট ৪৩ শহরকে স্বীকৃতি দিলেও তাতে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক কোনো শহর নেই। এটা একই সঙ্গে আশ্চর্যের ও বেদনার। এতে ইউনেস্কোর কর্মপরিধি বা প্রক্রিয়াকে একটা প্রশ্নের মধ্য ফেলে দেয়। ইউনেস্কোর যে সৃজনশীল শহরের নেটওয়ার্ক, তার ভেতর সাহিত্যের শহর আছে ৪৩টি। এখানে প্রাধান্য মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের শহরসমূহের। এ প্রক্রিয়া চলমান। মানে এ নেটওয়ার্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শহর যুক্ত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে, আবেদন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দেওয়ার বিষয় রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত এসে যেখানে পৃথিবীর ৪৩ শহর এ তালিকায় ঢুকে যেতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে ঢাকা নেই এতে খানিকটা আশ্চর্য তো হতেই হয়। সাহিত্যের শহর নিয়ে এরকম একটি তালিকার কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক এক সংবাদমাধ্যম যখন পশ্চিম বাংলার কবি সুবোধ সরকারের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইল, তিনিও তখন বিস্ময় প্রকাশ করলেন, জানতে চাইলেন কীভাবে বা কিসের ভিত্তিতে এ তালিকা হলো? কেন বাংলা ভাষার সাহিত্যচর্চার একটি কেন্দ্রও এ তালিকায় স্থান পেল না? ১৯৪৭-এর আগে বাংলা সাহিত্যের চর্চা হতো ঢাকা ও কলকাতাকেন্দ্রিক। ১৯৫২ সালে এসে ঢাকা ভাষার জন্য এমন একটি ঘটনার জন্ম দিল, যা পুরো পৃথিবীর সামনে উদাহরণ হিসেবে বিদ্যমান। ভাষার প্রসঙ্গে, মাতৃভাষার অপরিহার্যতার প্রসঙ্গে সেই একুশে একটি মাস্টহেড। বাংলা ভাষা রক্ষার এ আন্দোলন হয়ে উঠল পুরো পৃথিবীর ভাষাসংগ্রামের প্রতিভূ। একই সঙ্গে ঢাকাকেন্দ্রিক যে সাহিত্যচর্চা, তাও পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় পশ্চাৎপদ নয়। বইমেলা, সাহিত্য সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সাহিত্য আড্ডা, ছোটকাগজ প্রকাশ, বই প্রকাশ শিল্প- সব মিলিয়ে এ শহর সাহিত্যপ্রাণ শহর। গত শতকের পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বিউটি বোর্ডিংকেন্দ্রিক সাহিত্য ‘শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি’ ঘিরে সাহিত্যচর্চা থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এত সব রথী-মহারথী কবি-লেখক এখান থেকে উঠে এসেছেন যে, তা পুরো পৃথিবীর সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত মানুষের কাছে প্রেরণার মতো বিদ্যমান থাকার কথা। শুধু অনুবাদ সাহিত্যের অভাবে এসব কবি-লেখক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃতি হননি। কিন্তু যেখানে বেশিরভাগ ভাষা একটি আঞ্চলিক ভাববিনিময়ের মাধ্যম, যেখানে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রসঙ্গ এলে বিউটি বোর্ডিং একটি তীর্থস্থান; এরকম একটি তীর্থস্থানের জন্য একটি শহর তো সাহিত্যের শহর বলে বিবেচিত হতেই পারে। শেষে আবারো বলব, যেখানে সাহিত্যের ৪৩ শহর আছে, সেখানে ঢাকা নেই, তাতে এ প্রক্রিয়ার প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস তো তৈরি হয়ই। মনে হয়, স্বীকৃতি দানকারী সেই সংস্থাটিরও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য চেষ্টাটুকু করতে হবে। যেন এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে এই সংস্থাটি একটি গ্রহণযোগ্য সংস্থা হিসেবে বিবেচিত হয় সার্বিকভাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত