ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহান বিজয় দিবস এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনা

প্রদীপ সাহ
মহান বিজয় দিবস এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনা

আমাদের মহান বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। জাতীয় জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে এই দিনে আমরা মুক্তি এবং বিজয় লাভ করি। পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের গৌরব অর্জন করি। শত বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের গণমানুষ সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নয়, বাঙালি প্রাণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে।

১৯৭১ সালের সেই যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ। ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধ। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা পৈশাচিক হত্যালীলায় মেতে ওঠে। অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন আর নারী নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে। দুঃসহ এ জীবন-মরণ সংকটের মুখে বাঙালিকে আত্মরক্ষার তাগিদে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। তাদের সত্যিকারের যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিতে হয় এবং মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রাণ বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। নিরস্ত্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সাহসিকতা ও প্রবল দেশপ্রেমের কাছে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তানি সৈন্যের পরাজয় হয়। তাদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালির বিজয়, সার্থক হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং পরাজয় বরণ করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। ওইদিন পর্যন্ত দেশের মানুষ শুধু অপেক্ষায় ছিল কবে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসবেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। শুধু ৭ দিন কারাভোগ করেন বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আমলে। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। বাংলাদেশের মানচিত্র এবং একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পাওয়ার জন্য এতদিন তিনি কারাভোগ করেছিলেন। কোটি মানুষের স্বপ্ন ও ত্যাগে রচিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। এ ইতিহাস আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। বঙ্গবন্ধু ব্যতীত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনোদিনই সম্ভব হতো না। ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি এবং চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর এ যুদ্ধ সত্যি মহান। এ যুদ্ধের কোনোটাই পূর্ণতা পেত না, যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে ফিরে না আসতেন।

আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস এক অবিস্মরণীয় ও গৌরবময় দিন। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র লড়াই এবং ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে এ দিনটিতে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে যুগ যুগ ধরে এ দিনটি আমাদের প্রেরণা জোগাবে। বিজয় দিবসের পটভূমিতে রয়েছে দুই শতকের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। এদেশের মানুষ পরাধীনতার গ্লানি বহন করেছে দীর্ঘকাল। প্রথমে ব্রিটিশদের হাতে, তারপর পাকিস্তানিদের হাতে আমরা পরাধীন হই। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর আসে পাকিস্তানি শাসন।

পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালিদের ওপর আধিপত্যবাদ ও দমননীতির পথ বেছে নেয়। তারা আমাদের জাতীয় জীবনের সমুদয় মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এমনকি আমাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তাই ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানিদের কবল থেকে আমাদের মুক্তির লড়াই। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রায় ৯১ হাজার ৬৩৪ সৈন্য বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে দিনটিকে বাংলাদেশের জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে দিবসটি যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা ঘটে। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর সদস্যরা। কুচকাওয়াজের অংশ হিসেবে সালাম গ্রহণ করেন দেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী। কুচকাওয়াজ দেখার জন্য প্রচুর সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়। বিজয় দিবস শুধু আমাদের বিজয়ের দিন নয়, এটি আমাদের চেতনা জাগরণেরও দিন। তাই এ দিনটিতে প্রত্যেক বাঙালি নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়- বিশ্বসভায় আমরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যেন গণতন্ত্রকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারি এবং অশিক্ষা ও দারিদ্র্য থেকে দেশকে মুক্ত করে অগ্রযাত্রায় শামিল হতে পারি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত