ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশুর বেড়ে ওঠায় পারিবারিক শিক্ষা

ওসমান গনি
শিশুর বেড়ে ওঠায় পারিবারিক শিক্ষা

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই শিশুরাই হবে আগামী দিনের একটি জাতির কর্ণধার। তারাই পরিচালনা করবে রাষ্ট্র ও পৃথিবী। তাই ছোট থাকতেই তাদের নৈতিক ও মানসিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। আর এই শিশুদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে মা বাবা ও পারিবারিব শিক্ষাই তাদের মূল শিক্ষা। শিশুরা মূলত বাবা-মার কাছেই লেখাপড়া, নৈতিকতা, আদর্শ বা দেশপ্রেম সম্পর্কে জানতে শুরু করে। তাই মা-বাবাই হচ্ছেন শিশুর প্রথম আদর্শ শিক্ষক। কিংবা মা-বাবাকেই শিশুরা তাদের প্রথম আদর্শ গুরু হিসেবে মানতে শুরু করে। আর সে কারণে শিশুর বেড়ে ওঠা ও মেধা বিকাশে মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজন। পরিবার হলো অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম শিক্ষক হচ্ছেন মা-বাবা। এজন্য বলা হয়ে থাকে একজন সন্তানের জন্য পারিবারিক শিক্ষাটি খুব বেশি জরুরি এবং সেটি অবশ্যই আদর্শ শিক্ষা। আর এর সঙ্গে যোগ হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ডিগ্রি। পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ। মা-বাবার কাছেই শিশুর শিক্ষা-দীক্ষা শুরু। কিংবা মা-বাবাকেই শিশুরা তাদের প্রথম আদর্শ গুরু হিসেবে মানতে শুরু করে। আর সে কারণে শিশুর বেড়ে ওঠায় মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজন। শিশুর বেড়ে ওঠায় মা-বাবার ভূমিকা সম্পর্কে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হলেন- আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সব অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া। নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা বা শারীরিক শিক্ষার ফল- সবই পেয়েছি তার কাছ থেকে। অন্যদিকে ফ্রান্সের সম্রাট বা ইতালির সাবেক রাজা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন- তুমি আমাকে একটি আদর্শ মা দাও, আমি তোমাকে একটি আদর্শ জাতি উপহার দিব। আবার অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে- মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ, মা-ই হচ্ছেন শিশুর সর্বোৎকৃষ্ট বিদ্যাপীঠ। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে সন্তান সফলতা অর্জন করতে পারে। সন্তানের সাফল্যে বাবা-মায়ের যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি-জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে, ভালো ও আলোকিত মনের মানুষ হওয়া এবং এর জন্য সাধনা করে যাওয়া। আগে মানুষ হতে হবে তার সন্তানকে। তাই ছোট থেকেই মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বিনয়, লজ্জা, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝাতে হবে। পরিবার সন্তানের সবচেয়ে বড় শিক্ষার স্থান এটা ভুললে চলবে না। আর মা-বাবা সবচেয়ে বড় শিক্ষক। শিশু বা সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় রোল মডেল হলো তার বাবা-মা। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তারা সবসময় তাদের বাবা-মাকে আদর্শ ভাবে এবং তাদের সব কিছু অনুকরণ করে তাদের মতো হতে চায়। এই কারণে বাবা-মাকে বেশি সর্তক থাকতে হবে। এবং প্রকৃত পক্ষেই সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য সন্তানের সামনে নিজেদেরকে রোল মডেল হিসেবে তৈরি করে উপস্থাপন করতে হবে। পরিবারের কেউ কাউকে উপকার করলে ধন্যবাদ দিন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। ঘরের মানুষ বলে তাকে ধন্যবাদ দেওয়া যাবে না, এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন। আপনার এই ছোট পদক্ষেপ সন্তানকে কৃতজ্ঞতা বোধ শিক্ষা দিবে। পরিবারের কেউ ভুল করলে, একে অপরের কাছে দুঃখ প্রকাশ করুন। ছোট থেকেই সন্তানকে সামাজিক হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। তার সমবয়সি বাচ্চার সঙ্গে খেলতে দেওয়া, কোনো সমস্যা হলে মা-বাবা সাহায্য না করে, তার বন্ধুদের নিয়ে তার সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু অবশ্যই মা-বাবাকে দেখতে হবে সন্তান সামাজিকতা শিখতে গিয়ে যেন ভুল পথে না চলে। কিছুক্ষেত্রে দূর থেকেই নজর রাখতে হবে।

সন্তানকে পাঁচ বছরের পর থেকেই বাড়ির ছোট ছোট দায়িত্ব দিতে হবে। এর মাধ্যমে তার দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে। এই দায়িত্ববোধের জ্ঞান তাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করবে। দায়িত্বশীল মানুষ একদিন না একদিন জীবনে সফলতা পায়। তাই শিশুকে তার বয়স অনুপাতে দায়িত্ব দিন। যেমন- খেলার পর খেলনা গুছিয়ে রাখা, পড়ার টেবিল পরিষ্কার রাখা, জুতার ফিতা বাঁধতে শেখা ইত্যাদি। একটি শিশুর জন্মের পর তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের কোল। মা পরম যত্ন ও ভালোবাসায় সিক্ত করে, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যখন সন্তান আধো আধো কথা বলা শুরু করে, মা তখন চারপাশের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। কথা ফোটার সময় থেকেই মা যদি ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার শিক্ষা শিশুর মগজে গেঁথে দেন, তাহলে আশা করা যায় এই সন্তানটি চরিত্রবান সৎ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। তাই একথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, মা-বাবা হলেন সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রধান শিক্ষক। একটি শিক্ষিত পরিবারই পারে সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। আমাদের দেশের অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক তৎপর। কিন্তু তারা নিজেরা সচেতনতা অবলম্বন করে না। বর্তমানে অভিভাবকরা এতই সচেতন যে সন্তান যখন জন্মের পর কান্না করে, তখন তাকে শান্ত করার জন্য আর গল্প, ছড়া বা কবিতা শোনানো হয়। মোবাইল ফোনে গান, কার্টুন, বিলাসবহুল ভিডিও দেখালেই বাচ্চারা শান্ত হয়ে যায়। বাচ্চা যখন খেতে চায় না তখনো তাকে মোবাইল ফোনে দেখানো হয়। বাচ্চা যখন ঘুমাতে চায় না তখনো তাকে মোবাইল ফোন দেখতে দেখতে ঘুম পারানো হয়। যদি অভিভাবকরা এতই সচেতন হয় তাহলে কি এটিই হওয়ার কথা ছিল? যখন বাচ্চা একটু বড় হয়, কিছু বুঝতে শুরু করে তখন সাধারণ বাবা-মায়ের মতো সবাই সন্তানকে ভালো আদব শেখায়। কারো খারাপ না করা, ঝগড়া না করা, খারাপ কথা না বলা, মিথ্যা কথা না বলা, সর্বদা অন্যকে সাহায্য করা ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ তারা নিজেরা এগুলো পালন করার ব্যাপারে উদাসীন। তারা কি জানে না যে বাচ্চারা যা দেখে তাই শেখে। বাচ্চারা বাবা-মাকে যা করতে বা বলতে দেখে তারাও সেটিই শেখে। বাচ্চাদের খারাপ কাজে নিষেধ করে আমরাই যদি সেটি করি তাহলে বাচ্চারা কী শিখবে? বাচ্চারা যখন গালি দেয় তখন বাবা-মা শাসন করে, গালি দিতে নিষেধ করে। অথচ তারা নিজেরাই আবার গালি ব্যবহার করে। কোনো বাবা-মাই চায় না তার সন্তান খারাপ কথা শিখুক। কিন্তু এর জন্য শাসন যথেষ্ট নয়। বাবা-মায়ের নিজেদের প্রতিও সচেতন হাওয়া আবশ্যক। কারণ বাচ্চারা যা দেখে তাই শেখে। আশপাশের মানুষজন যা করে বাচ্চারাও তাই শেখে। পরিবেশও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বাবা-মায়ের উচিত তার সন্তানের সামনে উত্তম আচরণ করা। মায়ের প্রথম কর্তব্য হলো সন্তানকে স্রষ্টার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একটি শিশুসন্তান এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই অন্যকে অনুকরণ করতে পারে। অর্থাৎ তার ভেতর এ সময় থেকে অনুকরণ করার যোগ্যতা তৈরি হয়। বড়রা যা করে সেও আস্তে আস্তে তা করার চেষ্টা করে। সুতরাং সুযোগ তো মায়ের হাতে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মায়ের সঙ্গে ওঠবস করার সঙ্গে সঙ্গে একটি সন্তান নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত হতে পারে। মা যদি সুরাগুলো একটু জোরে পড়েন, দেখবেন কিছুদিন পর বাচ্চারা তা বলার চেষ্টা করছে। আর এটা স্বতসিদ্ধ যে, বাচ্চারা শোনা জিনিস দ্রুত মুখস্থ করতে পারে। দুই-তিন বছরের বাচ্চাদের খাবার খাওয়াতে বেশ সময় লাগে। তিনবেলা খাবার এবং বিকালের নাস্তা খাওয়ার সময়সহ মা একটা লম্বা সময় সন্তানকে দেন। আর বর্তমানে বেশিরভাগ মায়েরা বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় গান গায়, ছড়া বলে, গল্প বলে। আর টিভি কার্টুন তো খাবার খাওয়ানোর অন্যতম অস্ত্র। অর্থহীন ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাঝে’। অথবা ভীতিকর বাক্য ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’ কিংবা হিন্দি গান ইত্যাদি নানা কথা বলে থাকেন। প্রতিদিন যদি এগুলো বাচ্চারা শোনে তাহলে সে এগুলো আয়ত্ব করবে। অথচ মা যদি খাবার খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর সময় কোরআনের ছোট ছোট সুরাগুলো তিলাওয়াত করেন, ধর্মীয় গান, কবিতা শোনান তাহলে অল্প বয়সেই বাচ্চারা অনেক ভালো এবং জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় শিখতে পারবে। যা পরবর্তী জীবনে ফরজ ইবাদত ও প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করবে। একজন মা তার সন্তানকে শিশু বয়স থেকেই পরোপকারের গুরুত্ব বুঝাবেন। বিশেষ করে পরোপকারের ফলে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার ব্যাপারটা কত সুখের তা সন্তানের মাঝে জাগ্রত করতে হবে। যেমন- কেউ অসুস্থ হলো, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, ওষুধ মুখে তুলে দেওয়া। অন্ধ-বৃদ্ধদের রাস্তা পার করানোর কাজ। মা কাজগুলো করলে সন্তান শিখবে। গৃহপরিচারিকার সঙ্গের আচরণটাও ছোট বাচ্চার মনে দাগ কাটে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন অথবা পাড়া প্রতিবেশীর যে কোনো সমস্যায় মাকে যদি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখে তবে সন্তানও পরোপকারী হিসেবে বড় হবে।

শিশুরা খেয়াল করে, তার দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে বাবা-মায়ের ব্যবহার। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বাবা-মাকে যা করতে দেখে বাচ্চারাও তাই শিখে। বড়দের প্রতি গুরুজনদের প্রতি পিতা-মাতার সম্মান প্রদর্শন সন্তানকেও উজ্জীবিত করে। এই বাচ্চারাই বড় হয়ে তাদের পিতা-মাতার প্রতিও পূর্ণ আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রকাশ করবে।

যে পিতা-মাতা তাদের জনক জননীর হক আদায় করে না, সে অল্পকিছু দিন পর নিজ সন্তান থেকে প্রাপ্য সম্মান বঞ্চিত হবে। ঈশপের বিখ্যাত গল্পটির কথা তো কারো অজানা নয়। ছেলে যখন বৃদ্ধ বাবাকে ঝুড়িতে করে ফেলতে যাচ্ছে, তখন বৃদ্ধের নাতি বলেছিল- বাবা ঝুড়িটি নিয়ে এসো কেননা, তুমি বুড়ো হলে আমিও তোমাকে এটাতে করে ফেলে দিব। সুতরাং সাবধান থাকতে হবে বাবা-মায়েদের। যেহেতু মা থাকেন সন্তানকে ঘিরে দিনের অনেকটা সময়। তাই মায়ের দায়িত্ব বাবার তুলনায় অনেক বেশি। অবশ্য বাবা তো নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মায়ের পাশাপাশি ভূমিকা রাখবেনই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত