ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাদকের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো ভয়ংকর

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
মাদকের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো ভয়ংকর

আপনি জেনে অবাক হবেন দেশে অস্বাভাবিকভাবে মাদকের ব্যবহার ও মাদকাসক্ত লোকজনের সংখ্যা বেড়েছে। আর তাতে গোটা জাতি উদ্ধিগ্ন ও আতঙ্কিত। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ অনেক নেশাদ্রব্য আসছে। আর এসব নিরাপদে আনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিরাট অংশ জড়িত হয়ে পড়ছ। এমন ক্ষণে মাদক ও মাদকসেবী ও এর নিরাময় কেন্দ্রগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিরুপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর শরণপন্ন হতে বাধ্য হয়েছি। মাদক এখন সামাজিক ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। কেননা মাদক সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করছে যে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। মাদকের আগ্রাসনের শিকার হয়ে দেশের যুব সমাজ নৈতিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে সমাজের ওপর দেশের-শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল; তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যদি মাদকাসক্ত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে তাহলে সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ভয়ংকর অভিশাপ থেকে আমাদের যুব সমাজকে রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। আগে সাধারণত শহরের অতি ক্ষুদ্র বিত্তবান শ্রেণি ও গ্রামের বিলাসী ধনাঢ্য ব্যক্তির মাঝে নেশা করার প্রবণতা দেখা যেত। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হিরোইন, মদ স্পিরিট ইত্যাদির নেশায় মেতে উঠেছে। গরিব রিকশা-সিএনজিওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, কুলি, দিনমজুর, পথশিশু, কিশোর, বাস-ট্রাক ড্রাইভার, বড় ঘরের এক বিরাট অংশও নানারকম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। সত্য কথা বলতে কি, মাদকাসক্তি বর্তমান সময়ে সমাজের এক সর্বনাশা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আরো ভয়ের কারণ, সমাজে মূল্যবোধের নানারকম পতন-স্খলনের ছত্রছায়ায় দ্রুত বাড়ছে এই সর্বনাশা পাপ। মাদকাসক্তির ভয়াবহ ধ্বংস হতে রক্ষার জন্য অবশ্যই সামাজিক সচেতনতা জোরদার করা খুবই দরকার। তবে পাশাপাশি প্রয়োজন সমাজে যা তরুণদের জন্য হতাশার কারণ, সেই অর্থনৈতিক বেকারত্ব দূর করা। সমাজে মাদকাসক্তির বিস্তার বলতে গেলে এখন উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক ঘটনা হচ্ছে মাদকাসক্তি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রের অনৈতিক ও সমাজ বিধ্বংসী বাণিজ্যিক কার্যকলাপ। খোদ রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী শত শত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠলেও এগুলোর কোনোটিরই সরকারিভাবে বৈধ অনুমোদন আছে কি না সন্দেহ। এসব বেশিরভাগ নিরাময় কেন্দ্রের নেই কোনো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্স। মূলত অধিকাংশ নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে স্পর্শকাতর মাদকদ্রব্য বেচাকেনার আখড়াগুলোর সন্নিকটে। এসব কেন্দ্রের অধিকাংশের মধ্যেই সার্বক্ষণিক কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা মেডিসিনের ডাক্তার নেই। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার পরিষ্কার বিছানাপত্র, লকারসহ খাট, স্যালাইন স্ট্যান্ড, প্যাশেন্ট ট্রলি, স্ট্রেচার বেডপ্যান, ইউরিনাল, ড্রসক্যান, ফ্লেমিটার ও মাস্কসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার, ট্রান্সফিউসন সেট, ইলেকট্রিক শকার, স্টেরিলাইজার, সার্জিক্যাল কাঁচি, ব্লেড, রেফ্রিজারেটরসহ বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি এবং জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জেনারেটর থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এসবের বেশিরভাগই নেই। নেই অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণও। অথচ এসব কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যয়ভার অত্যধিক এমনও অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্র রোগীর আর্থিক সচ্ছলতা কিংবা পারিবারিক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে রীতিমতো ব¬াকমেইলিং করে থাকে। মাদকাসক্তি রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার নামে ক্লিনিকে রেখে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার হতে এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা করতে এসে অনেকে সর্বসান্ত হয়েছে। এমনকি চিকিৎসার নামে এসব কেন্দ্রে মাদকাসক্ত রোগীদের মারধর ও নির্যাতন করার অনেক অভিযোগও রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীরাই জড়িত এবং প্রয়োজনে কেন্দ্রগুলোকে তারা মাদকের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবেও ব্যবহার করতে দেখা যায়। নিরাময় কেন্দ্রে দীর্ঘদিন রোগী ধরে রাখার জন্য স্বল্প পরিমাণ মাদক প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি চালানো হয়ে থাকে। এটিকে সম্পূর্ণ অনৈতিক পদ্ধতি আখ্যায়িত করে দেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ পদ্ধতিতে রোগীকে কখনো সুস্থ করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, মাদক গ্রহণ ও এর বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকা একটি সামাজিক ও নৈতিক অপরাধ। এই অপরাধের বিস্তার রোধে দেশের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব ও ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও এনজিওগুলোকে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি কার্যকর বিধায় এ ব্যাপারে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোকেও মাদকবিরোধী অভিযানকে তারা যেন তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ করে নেন। কারণ, মাদকের ভয়াবহতা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, ভাষা, শ্রেণি, পেশা, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাইকে আক্রমণ করতে উদ্যত। এটি একটি সামাজিক অভিশাপ। বিশেষত নতুন প্রজন্ম এবং তরুণ-তরুণীরাই মাদকের ভয়াবহতার প্রধান শিকার। তাই শুধু বর্তমান না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে ও মাদকবিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণ সবার দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার রোগ নিরাময়ের চাইতে রোগ প্রতিরোধক উত্তম পন্থা। একইভাবে মাদকাসক্তি নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রগুলো সঠিকভাবে চলছে কি না সে ব্যাপারে কেন্দ্রগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি জোরদারের তাগিদ দেওয়ার অনুরোধ করছি। দেশব্যাপী যে হারে মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে থানাভিত্তিক মাদক প্রতিরোধ কমিটি স্থানীয় কমিশনার, চেয়ারম্যান বা সমাজসেবকদের নিয়ে সরকারিভাবে গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ড্রাগ সমস্যা মোকাবিলায় মূল্যবোধের শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত