ভেজাল রোধে রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান বৃদ্ধি হোক

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি একটি খবর গণমাধ্যমে ভাইরাল। ফেসবুক অন করলেই খবরটির বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পত্রিকার খবরে যাচ্ছে তা হলো-খুলনায় গরু ও খাসির মাংসের কথা বলে কুকুরের মাংস দিয়ে তৈরি বিরিয়ানি বিক্রির অভিযোগে তিন কিশোরসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। ১৩ নভেম্বর বিকালে খুলনা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পরিত্যক্ত একটি ভবন থেকে তাদের আটক করা হয়। আটক সবাই খালিশপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। তিন কিশোরের বাইরে আটক অন্যজন হলেন খালিশপুরের বঙ্গবাসী মোড় এলাকার নর্থ জোন-২৩ এর হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. আবু সাইদ (৩৭)। বেশ কয়েকবার একই ঘটনা ঘটায় ও পরিত্যক্ত ভবন থেকে কয়েক দিন ধরে দুর্গন্ধ আসায় স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হয়। ঘটনার দিন বিকালে স্থানীয় এলাকার লোকজন কয়েকজনকে একটি কুকুর নিয়ে সেখানে যেতে দেখেন।

খবর দিলে পুলিশ এসে তিনজনকে আটক করে। পরে ওই মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে বিক্রি করে এমন একজনকেও আটক করা হয়। এ সময় সেখানে পা বেঁধে গলা কেটে রাখা একটি কুকুর পাওয়া যায়। সেদিন রাতে খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন এই খবরের সত্যতা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আটক ব্যক্তিরা জানিয়েছে যে তারা প্রায় এক মাস ধরে কুকুরের মাংস দিয়ে বিরিয়ানির ব্যবসা করছিল’। স্থানীয়রাও বলছে, ইনস্টিটিউিট অভ্যন্তরের একটি পরিত্যক্ত ভবনে র্দীঘদিন ধরে কুকুর জবাই করা হচ্ছিল। ওই ভবনটি থেকে অনকেগুলো কুকুরের চামড়া ও হাড় উদ্ধার করা হয়ছে। আটককৃতরা জানিয়েছেন তারা প্রায় এক মাস কুকুরের মাংস দিয়ে বিরানিয়ানি ব্যবসা করছে। খালিশপুর বঙ্গবাসী এলাকায় প্রতি প্লটে বিরায়িনি মাত্র ৩০ টাকায় বিক্রি করে তারা। এ ঘটনায় আটককৃতরা হলেন- চক্রের মূলহোতা নগরীর খালিশপুরস্থ ডলার হাউজ মোড় এলাকার লিংরোড হাওলাদারের ছেলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তাজ (১৬), খালিশপুর বঙ্গবাসী মোড় এলাকার নর্থ জোন-২৩ এর হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. আবু সাইদ (৩৭), ২নং নেভিগিটের এলাকার কুতুব আলীর ছেলে মো. সিয়ম (১৬), চরের হাট এলাকার শোভন সরদারের ছেলে প্রেম সরদার (১৬)। কুকুরের মাংসের ক্রেতারা ও ভ্রাম্যমাণ বিরিয়ানি বিক্রি করত আবু সাঈদ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরমান, উৎস, রনি ও ফজল এখনো পলাতক। ঘটনার বিষয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রাণি কল্যাণ আইনে ২০১৯-এর ৭ ধারায় মামলা করার পর আসামিদের আদালতে প্রেরণ করা হয়। এ ঘটনাটি আপাতত ‘টক অব দ্য ডে’ হয়েছে খুলনার আদালতপাড়াসহ পুরো খুলনাজুড়ে। শহরের প্রতিটি রেস্তোরাঁগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষজনের একটা বিরূপ মন্তব্য দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে যখন নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমূখী, তখন মানুষজন সস্তায় কিছু পেলে তা স্বস্তিবোধ করে কিনে নেয়। ঠিক তেমনি ৩০ টাকায় বিরিয়ানির প্যাকেট, তাও আবার একপিস মাংসসহ এটা অনেকেই কিনতে ভুল করেনি। প্রতারণা যে কত প্রকার ও কত নিকৃষ্ট হতে পারে তার বোধ হয় শেষ নেই! তা এরকম ঘটনাগুলো থেকে অনুমান করা যায় সহজেই। এছাড়াও আরেকটি এমন ঘটনার ঘটেছিল ২০২১ সালে রাজশাহীতে। পত্রিকার খবরে এসেছিল- ‘রাজশাহী মহানগরীতে মরা ছাগলের মাংস, মরা জবাই করা ছাগল ও অসুস্থ ছাগলের মাংস সরবরাহ করত একটি অসাধু চক্র। ওই চক্রের চার সদস্যকে অবশেষে হাতেনাতে আটক করেছে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশ। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে ১৫০ কেজি মরা ছাগলের মাংস, চারটি মরা জবাই করা ছাগল ও ২৭টি অসুস্থ ছাগল উদ্ধার করা হয়েছে। গত শনিবার গভীর রাতে তারা ধরা পড়ে। পরে গত রোববার সকালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে- দীর্ঘদিন ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ এলাকা থেকে মরা ছাগলের মাংস ও মরা জবাই করা ছাগল এবং রুগ্ন-অসুস্থ ছাগল কম দামে কিনে নেন তারা। পরে সেগুলো নিয়ে এসে রাজশাহী মহানগরের বিভিন্ন খাবার হোটেল, রেস্তোরাঁ, চাইনিজ রেস্তোরাঁ, বিরিয়ানি হাউজ, কারাগার, হাসপাতাল ও বাজারে সরবরাহ করত। আটকরা হলেন রাজশাহী মহানগরীর দরগাপাড়া এলাকার মশিউর রহমান আপেল ও ফয়সাল হোসেন এবং তাদের সহযোগী কায়েস ও ফাইসাল। এরমধ্যে আপেল ও ফয়সাল হোসেনকে ভোক্তা অধিদফতরের মাধ্যমে ৮০ হাজার টাকা করে দুজনকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মাংসগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলার পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। (সূত্র : বাংলা নিউজ, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১)। এসব ঘটনা হয়তো অনেক ঘটছে কিন্তু কয়টি খবর আমাদের কানে আসে বা দেখছি। আরেকটি খবর পুরোনো হলেও তুলে ধরলাম। ‘আপনার প্লেটের মুরগির মাংসের টুকরোটা কি মরা মুরগির? প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যাবেন না, এমনও তো হতে পারে এই মাংস জবাইয়ের আগেই মরে যাওয়া মুরগির। কারণ, রাজধানীর কিছু হোটেল ও মেস বাড়িতে একটি অসাধু চক্র সাপ্লাই দেয়, এমনই মরা মুরগির মাংস। আর না জেনে সেগুলো খায় হাজারো মানুষ। নিউজ টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্যই উঠে এসেছে। ব্যস্ত জীবনে তিন বেলা বাড়ির রান্না খাওয়ার সুযোগ নগরবাসীর হয় না বললেই চলে। এক্ষেত্রে হোটেল-রেস্তোরাঁই ভরসা। অনেকে আবার তিন বেলাই রেস্তোরাঁর ওপর নির্ভরশীল। সেখানে আপনার প্লেটে তুলে দেওয়া হচ্ছে মরা মুরগির রোস্ট বা ভুনা মাংস। যদিও প্লেটে তুলে দেওয়া মাংস মরা মুরগির কি না তা হয়তো রেস্তোরাঁয় খেতে বসে আপনার পক্ষে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু, একবারও কি ভেবেছেন রাজধানীতে প্রতিদিন যে মুরগিগুলো মারা যায় সেগুলো কোথায় যায়? ডাস্টবিনে তো তা কখনো দেখা যায় না! তাহলে কি কোনো মুরগি মারা যায় না? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে মারা যাওয়া মুরগিগুলো সস্তা দামে কিনে নিচ্ছে হোটেল ও রোস্তারাঁগুলো। পরে রান্না করে তা পরিবেশন করা হচ্ছে ভোক্তাদের খাবার টেবিলে। আর এ কাজে জড়িত রয়েছে কিছু অসাধু চক্র, যারা হোটেল ও রেস্তোরাঁয় এই মরা মুরগিগুলো সরবরাহ করছে। অনেক ক্ষেত্রে হোটেল কর্তৃপক্ষই জানে না যে, ড্রেসিং করে আনা মাংসগুলো মরা মুরগির। আবার কেউ কেউ জেনেশুনেই বেশি লাভের জন্য কম দামে এই মাংস কিনছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরা মুরগির মাংসে মারাত্মক রোগব্যাধী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এ মুরগিগুলো নানা রোগের কারণেই মারা যায়’। (সূত্র: নিউজ ২৪, ৪ নভেম্বর, ২০১৭)। কর্ম ব্যস্ততায় জীবনের প্রয়োজনে আমরা যান্ত্রিক জীবনের সামিল হয়ে যাচ্ছি। তিন বেলা খাবার আমাদের বাসায় খাওয়ার সময় হয়ে ওঠে না। তাই নির্ভর করতে হয় অনেকাংশে বাইরের খাবারের প্রতি। রেস্তোরাঁয় হয়তো দুয়েক বেলা রেগুলার খাবারের রুটিন অনেকের। এ ছাড়াও অনেক বাসা বাড়িতেও স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরিজীবী হওয়াতে রান্নার সময় না পেয়ে অনলাইন বিরানি অর্ডারসহ ফাস্ট ফুড বা অন্যান্য খাবারের প্রতি আস্থা রাখতে হয়। দেশের শহর-নগর সব হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁর প্রতি যখন আমাদের এতটা নির্ভর, তাই এমন জায়গায় আমাদের খাবর খেতে হলে একটু সচেতন হতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রতিটা হোটেল-রেস্তোরাঁয় উপযুক্ত খাবার পরিবেশন হচ্ছে কি না সেটার তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটা হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান বৃদ্ধি করতে হবে, পাশাপাশি প্রতিটা বাজার মালিক সমিতির কমিটিকে এসব তদারকির দায়িত্ব ও পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে।