ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শি জিনপিংয়ের ভিয়েতনাম সফর এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

অলোক আচার্য
শি জিনপিংয়ের ভিয়েতনাম সফর এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

ভূরাজনীতি এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিনিয়তই ভূরাজনীতির চিত্র পরিবর্তন ঘটছে।

ভূরাজনীতিতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থির রাখা, সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সম্পর্কের মেরুকরণ বাণিজ্য এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দীর্ঘ ৬ বছর পর ভিয়েতনাম সফরে যান। এ সফরে তিনি ভিয়েতনামের নেতা নগুয়েন ফু ত্রংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। এই দুই নেতার সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট-শাসিত দেশ দুটির ‘ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব’ নতুন রূপ পাবে বলে ধারণা অনেকের। সফর নিয়ে আলোচনার কারণ হলো দেশটি ভিয়েতনাম এবং ভিয়েতনামের সাথে চীনের সম্পর্ক উষ্ণ নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভিয়েতনামের সম্পর্ক বেশ ভালো।

আর ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টায় কিছু স্বার্থও রয়েছে। চীন তাদের মধ্যকার তিক্ততা ভুলে দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে বলেই মনে হয়। একইসাথে ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিযোগিতায় আসা এই সফরের একটি উদ্দেশ্য ছিল। দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।

কারণ চীনের সঙ্গে ২০০৮ সালে ভিয়েতনামের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ চুক্তি হয়েছিল। চীনই হলো ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২১ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার কোটি ডলার। চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের পুরোনো ঐতিহ্যগত সম্পর্ক। কিন্তু বহুদিন ধরেই দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে দুই দেশের মধ্যেই রয়েছে দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হলে চীনকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে এবং এটা সত্যিকারের প্রতিবেশী দেশের মতো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এর বাইরেও ভিয়েতনামের জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে কারণ দেশটির জনগণের একটি বড় অংশই চীনের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে বেশি ইতিবাচক নয়। ভিয়েতনামের ওপর প্রভাব বিস্তারে সম্প্রতি রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছে পরস্পরবিরোধী দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

যার ফলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশ দুটির মধ্যে নতুন করে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও শুরু হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয় বরং এটি এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। ইতিহাস ও আন্তর্জঅতিক গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে ১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে তাদের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক, যার মধ্যে ১৯৭৯ সালের সীমান্ত যুদ্ধও অন্তর্ভুক্ত।

এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। এখনও অনলাইনে বা বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ভিয়েতনামের এ বিষয়গুলো নিয়ে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা হয়। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের ভিয়েতনাম সফরে দেশ দুটির মধ্যে সহযোগিতার লক্ষ্যে ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দেশ দুটির মধ্যে আন্তর্জাতিক রেলযোগাযোগ নিয়ে সমঝোতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো শি জিন পিংয়ের সফর এর বাইরেও এত গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? উত্তর হলো এর কয়েক মাস আগেই ভিয়েতনাম সফর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তিনি ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে সেমিকন্ডাক্টর খাতে বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছেদের পর ভিয়েতনাম হতে পারে পারে নতুন বাঘ। তাই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এই সফর জো বাইডেনের সফরের পাল্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতার আভাস নয় বরং স্পষ্ট কিছু কারণ দেখা গেছে যা যৌক্তিক।

গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভিয়েতনাম সফর করেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে উন্নীত হয় ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চীনকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। কৌশলগত অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নিরিখে ভিয়েতনামকে যে স্তরে রাখে চীন, সেই একই স্তরে জায়গা করে নেয় ওয়াশিংটন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাঝেমধ্যেই ভিয়েতনামে চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। ২০১৪ সালে দাঙ্গা বাধে দেশটিতে, যাতে বহু মানুষের প্রাণ যায়। সে সময় কয়েক ডজন বিদেশি মালিকানাধীন কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল ভিয়েতনাম যে জলসীমা তাদের নিজস্ব বলে দাবি করে থাকে, সেখানে চীনের তেল পরিশোধনের স্থাপনা (ওয়েল রিগ) বসানো নিয়ে।

কয়েক বছর আগে হ্যানয়ের দোকানগুলোয় শুধু ভিয়েতনামের তৈরি পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছিল। চীন থেকে আমদানি করা পণ্য তারা বর্জন করে তখন। ফলে ধারণা করা হচ্ছে যে জিন পিংয়ের এ সফরের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে বহুমুখী সমস্যায় ফেলেছে এবং নতুন নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। পৃথিবীজুড়েই আর্থিক সংকট অর্থাৎ তীব্র মুদ্রাস্ফীতি। এর সাথে রয়েছে জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে কৌশলগত অবস্থান। এই অবস্থান এড়াতে পারছে না বড় অর্থনীতির দেশগুলোও। কারণ এর জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় অন্যদেশগুলোর ওপর।

স্বাভাবিকভাবেই যেসব দেশে প্রয়োজনীয় সরবরাহ রয়েছে এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে সেখানে বিশ্বের ফোকাসটাও সেখানেই থাকবে। এটাই বিশ্ব রাজনীতি। বিশ্ব রাজনীতি হলো গিভ অ্যান্ড টেক নীতি। এখানে উদারনীতি বলে কিছু নেই। রয়েছে সম্পর্ক উন্নয়নের তোড়জোড়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক এমন একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে প্রতিনিয়তই দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে। পরাশক্তিগুলো নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করছে। যে দেশের কাছে যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট জড়িত সেখানেই সম্পর্কের তোড়জোড়। স্বার্থ বহুবিধ হতে পারে।

তা আঞ্চলিক সুবিধা আদায় হোক, বাণিজ্য স্বার্থ হোক আর তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্যই হোক। তাছাড়া রয়েছে ক্ষমতায়নের বিশ্বে ক্ষমতা দখলের তোড়জোড়। কে পৃথিবীর মুরুব্বী হয়ে খবরদারি করবে, তার সাথে কোন কোন দেশ থাকবে, তাদের স্বার্থ রক্ষার উপায় কি হবে এসব বিষয়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতি গরম হয়ে আছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই এই প্রতিযোগিতা চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভেতর। সামরিকয়ান, বাণিজ্য, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি নিয়ে নতুন সমিকরণের যুগে প্রবেশ করেছে পৃথিবী। এবার পরিস্থিতি বিবেচনার বিষয়। এটা এমন এক সময় যখন পৃথিবী যুদ্ধ-বিগ্রহ, উদ্বাস্তু এবং বহুরৈখিক সমস্যাগ্রস্থ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফরের পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের এই ভিয়েতনাম সফর করেন। দেশ দুটি দেশ দুটির মন্ত্রণালয়, খাত, সংস্থা ও স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতার চুক্তি হয়েছে।

মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক পশ্চিমা কোম্পানি চীন ছেড়ে ভিয়েতনাম, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। তবে এসব বিনিয়োগ টানায় এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভিয়েতনাম। রেড রিভারের ওপর সেতু নির্মাণ করে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে ভিয়েতনামের লাও কাই প্রদেশের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যেও চুক্তি হয়েছে দেশ দুটির মধ্যে। ভিয়েতনামের সঙ্গে আগের থেকে চীনের রেল সংযোগ রয়েছে, তবে সে সিস্টেমগুলো অনেক পুরোনো। সেগুলোয় আন্তঃসংযোগ সক্ষমতা নেই। পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে রেল ব্যবস্থা নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হবে। নতুন রেলপথটি ভিয়েতনামের বৃহত্তম বিরল খনিজ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাবে। এতে চীনের বিরল খনিজ পরিশোধনের ওপর আধিপত্য বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যাই হোক শি জিনপিংয়ের এই সফর ভিয়েতনামের সাথে দেশটির সম্পর্কে নতুন মাত্রা অবশ্যই সৃষ্টি করবে এবং সেই সাথে তৈরি করতে পারে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত