ভূগর্ভস্থ পানি ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা

অমৃত চিছাম

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ হলো জল আর এক ভাগ স্থল। কিন্তু এ সিংহভাগ পরিমাণ জল থাকা সত্ত্বেও সব সময় এগুলো দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার উপযোগী হয় না। আমরা প্রতিদিনের প্রাত্যহিক জীবনে প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি ব্যবহার করি। পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া একদিনও কল্পনা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা প্রায় একই কথা। ওই উপাদান কোনো না কোনোভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেই ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো না কোনো কাজে আমরা পানির ব্যবহার করে থাকি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে কয়েকটি বিষয় আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে তার মধ্যে একটি অন্যতম হলো পানি। এমনকি অনেকে এমনও মনে করেন যে, ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়, তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে পানি।

প্রথমে আসা যাক ভূগর্ভস্থ পানি কি? ভূগর্ভস্থ পানি হলো- ভূপৃষ্ঠের নিচে সঞ্চিত পানি সম্পদ যা প্রধানত ভূপৃষ্ঠের সঞ্চয়িত পানি নিয়ে গঠিত। এই পানি মৃত্তিকা ও তার রন্ধ্রে সঞ্চিত থাকে। ভূগর্ভস্থ পানির উপরের স্তরকে বলে ভূজলপৃষ্ঠ পৃথিবীর স্বাদু পানির প্রায় ৩০ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। তবে আহরণযোগ্য সাধু পানির প্রায় ৯৭ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। নদী জলাশয়ে এই পানির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। বাদ বাকি ৬৯ শতাংশ হিমবাহ আকারে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, বিশেষ করে সুপেয় পানি দিন দিন ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। কারণ আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রায় প্রতিটি কাজে প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি ব্যবহার করি। দেশে বর্তমানে ওই বিষয়টি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন যে হারে সুপেয় পানি উত্তোলন করি; কিন্তু সেই হারে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হয় না। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ দেশব্যাপী বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় উক্ত বিষয়টি সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মানুষের বাস তাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণ সুপেয় পানি প্রয়োজন। দূষণ, দখল ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীসহ চারপাশের নদী ও জলাশয়ের পানি বর্তমানে প্রায় ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ায়, নগরীর প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার ঘরে ও শিল্প-কারখানাসগুলোর চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মাটির নিচ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয়। অবাক করার মতো বিষয় এই যে, শুধু ঢাকা ওয়াসাই প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে, যা দিয়ে মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সমান প্রায় ২০টি স্টেডিয়াম পূর্ণ করা সম্ভব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্যমতে, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন?দেশে অভ্যন্তরে বসবাসরত এ বিশাল জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়, দেশব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়ে থাকে, যার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করা হয় ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে নানা প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করে উত্তোলনের মাধ্যমে। দেশে ভূগর্ভস্থ পানির উল্লেখযোগ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হলো- খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, সেচ ও শিল্পক্ষেত্রে। দিন দিন দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ও তাদের বহুমাত্রিক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির উপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। দেশে সেচ ব্যবস্থার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল উল্লেখ্য, ভূগর্ভস্থ পানি হতে প্রতিবছর প্রায় ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়। যার মধ্যে প্রায় ৮৬ শতাংশই ব্যবহার করা হয় সেচ কাজে। প্রতিবছর অধিক পরিমাণ উত্তোলনের ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা মৌসুমে গভীর ও অগভীর নলকূপগুলোতে পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। অত্যাধিক উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামলে থাকলে ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে সুপেয় পানির উৎস। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কৃষি ও শিল্প খাতে। এছাড়াও আশঙ্কা আছে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের। জাতিসংঘের চালানো সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা হতে দেখা যায়, অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১০টি দেশ স্থান পেয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। পাউবো এবং গবেষকরা বেশ কয়েক দশক আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিল ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় শঙ্কার কালোমেঘ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে সবার মাঝে। রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিসংখ্যান বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটার, যা পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার নিচে নামে, ২০১০ সালে ৬০ মিটার ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে এসে যা ৭৫ মিটার নিচে নেমে গেছে। ২০৫০ সালের দিকে যা আরো ভয়াবহ রূপধারণ করবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১২০ মিটারে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওয়াসার তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন ৩৫ লাখ ঘনমিটার, ২০৩০ সালে ৪৩ লাখ ঘনমিটার, ২০৩৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ৫২ লাখ ঘনমিটার পানির প্রয়োজন হবে রাজধানী ঢাকায়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কিরূপ পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে তা চিন্তা করলেই গাঁ শিহরে উঠে।

ঢাকার কেন্দ্রে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় একটি শূন্যস্থান চিহ্নিত করেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। ভূতত্ত্বের ভাষায় উক্ত ঘটনাকে বলা হয় ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’। আর এ ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’-এর বিস্তৃতি রাজধানী ঢাকার কেন্দ্র হতে শুরু করে আশপাশের উপজেলাগুলোতে। উপজেলাগুলো হলো- টঙ্গী, সাভার, ধামরাই, দোহার ও নবাবগঞ্জ এবং এর বিস্তৃতি প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এ বিশাল জায়গাজুড়ে ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’ থাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা থাকলেও, শঙ্কার মাঝে আশার আলো, বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের ভূগর্ভের বালির মধ্যে বিধ্যমান বিশেষ বৈশিষ্ট, যার ফলে এখন পর্যন্ত মারাত্নক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে ওই স্থানগুলো। ভূগর্ভস্থ জলাধারের উপরের অংশের পুরু পলির স্তর বালির কণা পুনর্গঠন ও কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার চাপ সামলে নিতে পারছে। পলির ধরনের ওপর নির্ভর করে বৃষ্টি বা বন্যার পানি ১০০ মিটার বা ৩২৮ ফুট গভীরে যেতে অন্তত ১০০ বছর এবং ৩০০ মিটার বা ৯৮৪ ফুট গভীরে যেতে প্রায় ১ হাজার বছর সময় লাগে। ওই বৃষ্টি বা বন্যার পানি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় সময় থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় গ্রাউন্ট ওয়াটার রিচার্জ হতে কি পরিমাণ সময়ের প্রয়োজন। ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। এ দিবস উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী পানি সংকট সম্পর্কে উত্তর উত্তর জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও ‘এসডিজি ৬’ এ বর্ণিত ২০৩০ সাল নাগাদ সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা শুনিশ্চিত করা। পরিশেষে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের বিষয়টি নগর-পরিকল্পনা, বসতবাড়ি পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করতে হবে। পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষকে আগামী ২ বছরের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের পানি ৯০ শতাংশ ব্যবহারের জন্য কার্যকর পদক্ষেক গ্রহণ করতে হবে। নাগরিকদের মাঝে পানির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীর পাশ থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দেওয়া। অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করা। ঢাকার আশপাশের নদীসহ অন্যান্য সব নদী ও জলাশয় দখল, ভরাট ও দূষণ রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা। শুধু ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্নবীকরণ ও সংরক্ষণই নয়, প্রয়োজন বিকল্পভাবে জলের ব্যবহার বাড়ানো। রাষ্ট্রসংঘের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, একজন মানুষের সারাদিনে খাওয়ার জন্য দরকার ৫ লিটার জল, স্যানিটেশনে ২০ লিটার, স্নানের জন্য ১৫ লিটার আর রান্নার জন্য ১০ লিটার। মোট ৫০ লিটারের মতো পানি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ৬৭৬ বর্গমিটার বাড়ির ছাদের বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারলে তা অন্তত ৪০ জন মানুষের সারা বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। আর ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও আরও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন কমানোর। অধিক পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ায় পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দেয়। এছাড়া মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। এজন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায়, রেডিও, টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, যাতে সবাই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের প্রতি আরও যত্নশীল হয়। সর্বোপরি ভূগর্ভস্থ পানির যথাযথ সংরক্ষণ ২০৩০ সালে ‘এসডিজি ৬’ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে, সেইসঙ্গে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে- এটাই দেশের সব মানুষের প্রত্যাশা।