পুলিশের ছিনতাই : মানুষের অসহায়ত্ব

সংশয় নিরসনে পুরো ঘটনা নিয়ে বিফ্রিং দরকার

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীতে ডিবি পুলিশের নামে দুইজন উপ-পরিদর্শকের এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে ৯ লাখ টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়ার ঘটনার খবর বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল প্রকৃত অর্থে তারা আসল পুলিশ অফিসার কিনা। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর যাচাই-বাছাই করে জানা গেল, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত দুই পুলিশ অফিসার আসলে ভুয়া পরিচয় দিয়ে ছিনতাই করেননি। তারা রাজধানীর একটি থানায় কর্মরত। তারা দুইজন মিলে ডিবি পুলিশের ছদ্মবেশে এই অপকর্মটি করেছেন। অনেক সময় ভুয়া পুলিশ পরিচয় দিয়ে এমন অঘটন ঘটানোর সঙ্গে জড়িত অনেকে এর আগে আটক হয়ে আইনের আওতায় এসেছেন। তবে যে দুইজন উপ-পরিদর্শক ছিনতাইয়ের কাজে অংশ নিয়েছিলেন, তারা আটক হয়ে এখন পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। এটা একটা স্বস্তির খবর। তা না হলে আগামীদিনে হয়তো তারা এমনি আরো সর্বনাশা ঘটনা ঘটিয়ে পুরো পুলিশ বাহিনীকে জনগণের প্রশ্নের মুখোমুখি করতেন। যে ভিকটিম তার অভিযোগ পুলিশকে জানিয়েছেন, তাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। কেননা, তিনি সাহস করে এই কাজটি করেছেন। তবে এই ঘটনার পেছনে অন্য কোনো ঘটনা থেকে থাকলে তার রহস্য উন্মোচন হওয়া দরকার। ভিকটিম সত্যিই যদি ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি থাকবে এবং তার এই দৃষ্টান্ত মানুষ অনুস্মরণ করবে। আর যদি অন্য কোনো বিষয় এখনো লুকায়িত থাকে, তাহলে অভিযোগকারীও যেন আইনের আওতায় আসে। দুই এসআইকে গ্রেপ্তার করার পর স্থানীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গণমাধ্যম কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় সবাই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটা সুশৃঙ্খল বাহিনীর দুই কর্মকর্তার এমন জঘন্য কর্মকাণ্ড সহজেই মেনে নেয়ার মতো নয়। কেননা, যারা আইনের রক্ষক তারা যদি ভক্ষক হয় তাহলে মানুষ অত্যন্ত অসহায় বোধ করে। মানুষের আশা-ভরসার আলোকবর্তিকা অন্ধকারে ঢেকে যায়।

ছিনতাইয়ের অভিযোগে দুইজন এসআই গ্রেপ্তার হওয়ার পর নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এটা কি করে সম্ভব। পুলিশের দুইজন কর্মকর্তা পুলিশেরই হাতকড়া ব্যবহার করে একজন নাগরিককে আটক করে চোখ বেঁধে নির্জন বাড়িতে নিয়ে নির্যাতন করে নগদ অর্থ ও এটিএম কার্ডের পিন নম্বর নিয়ে ৯ লাখেরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিল- এটা কীভাবে সম্ভব। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেল রাজধানীর শাহ আলী থানায় কর্মরত ছিলেন অভিযুক্ত ছিনতাইকারী পুলিশের এসআই তুহিন কাজী ও মশিউর রহমান তাপস। পুলিশ সাধারণের বন্ধু বলে পুলিশ বিবেচিত হলেও এ দুইজন ছিলেন উল্টো। তারা ছিনতাই করতেন। তারা ছিনতাই করতেন ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে শেরে বাংলা থানা পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। মো. শাহাদাৎ সরদার নামে এক ভুক্তভোগীর মামলায় এসআই তুহিন ও তাপস গ্রেপ্তার হন। মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী মো. শাহাদাৎ সরদার জানান, গত ৯ ডিসেম্বর তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক ছোটভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। ছোটভাইকে না পেয়ে একটি রিকশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান্থপথে রওনা করেন। আনুমানিক বিকাল সোয়া ৩টার দিকে শেরেবাংলা নগর থানার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন ভবনের কাছে পৌঁছলে একটি নীল রংয়ের প্রাইভেটকার তাকে বহনকারী রিকশাটির গতি রোধ করে। ওই গাড়ি থেকে তিনজন লোক নেমে ডিবি পরিচয় দিয়ে তাকে তুলে নেন। প্রাইভেটকারে তুলে তাকে হাতকড়া পরিয়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। শাহদাৎ বলেন, তারা আমার প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ, ভিভো ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। ফোনটিতে থাকা দুটি সিম খুলে আমাকে দিয়ে দেয়। আমার পকেটে নগদ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিল, সেগুলোও নিয়ে নেয় ওই তিন ব্যক্তি। এরপর তারা আমাকে একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আমার মানিব্যাগ থেকে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম কার্ড নেয়; পরে সেটির পিন দাবি করে। আমি পিন কোড দিতে অস্বীকার করলে তারা আমাকে এলাপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। আমি আমার জীবন রক্ষার্থে তাদের এটিএম কার্ডের পিন কোড বলে দিই।

তিনি আরো বলেন, আসামিরা এটিএম বুথে গিয়ে কার্ডে থাকা টাকার পরিমাণ জেনে নেয়। পরে আমার ফোনে তারা নেক্সাস পে অ্যাপ ইন্সটল করে-এর মাধ্যমে অ্যাকাউন্টের সব টাকা ট্রান্সফার করে নেয়। বিবাদীরা সিটি ব্যাংকের (১৫০২৪৯৯৫৪৩০০১) একটি অ্যাকাউন্টে পর্যায়ক্রমে ৩ লাখ ১০; ৩ লাখ ১০; ১ লাখ ৩৩ হাজার ১০ টাকা করে মোট ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩০ টাকা স্থানান্তর করে নেয়। তারা নগদ ও ব্যাংক মিলিয়ে মোট ৯ লাখ ১৯ হাজার ২৯ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। শাহদাৎ জানান, আসামিরা একটি সাদা কাগজে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর রাখেন। তারপর আবার তাকে হাতকড়া পরিয়ে, চোখ-মুখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে নেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে মিরপুর-১ নম্বরের পাশের কোনো এলাকায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি তার বাড়ি ফিরে যান। শাহদাৎ পুলিশ সদস্যদের দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন- এটি কীভাবে বুঝতে পারলেন, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু তিনি বা পুলিশের কাছ থেকে জানা যায়নি। পুলিশই বা কীভাবে মামলার পর তুহিন ও তাপসকেই শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করল এ বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পুলিশের স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তবে ঘটনা যাই হোক মানুষের মধ্যেকার বিভ্রান্তি দূর করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে একটা বিফ্রিং দেয়া দরকার। তাহলে মানুষ আসল ঘটনা বুঝতে পারবে। পুলিশ কর্মকর্তারা তো আইনের ঊর্ধ্বে নন। এর আগে যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে, তারা আইনের আওতায় এসেছেন তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। কেননা, ব্যক্তি বিশেষের দায় তো পুরো বাহিনী নিতে পারে না।