নবাবি আমলের শেষ অঙ্কে লেখা সিরাজউদ্দৌলার চিঠিপত্র

মুহিত হাসান

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘...মহান আল্লাহতাআলা ও নবী-রাসুলদের নামে কসম খেয়ে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইংরেজ কোম্পানি তাদের দ্বারা খননকৃত খাল বুঝিয়ে দেয়া, তাদের নির্মিত [ফোর্ট উইলিয়াম] দুর্গ গুটিয়ে নেয়া এবং নবাব জাফর খানের আমলে প্রচলিত শর্তগুলো মেনে পুনরায় ব্যবসা করার ব্যাপারে সম্মত না হবে, ততক্ষণ অবধি আমি তাদের তরফ থেকে কোনো কথাই শুনব না এবং তাদের আমার দেশ থেকে সমূলে উৎখাত করার পদক্ষেপ নেব...।’ ২৮ মে, ১৭৫৬ তারিখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানীয় ‘এজেন্ট’ বা সমঝোতাকারী ধুরন্ধর আর্মেনীয় লবণ ব্যবসায়ী খোজা ওয়াজিদকে রাজমহল থেকে প্রেরিত এক চিঠিতে এমনই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। বাংলার এ হতভাগ্য নবাব কখনো আত্মজীবনী বা কবিতা লিখেছেন বলে ইতিহাসে শোনা যায় না।

অগত্যা নবাবি আমলের শেষ অঙ্কে লেখা তার কিছু দাপ্তরিক চিঠিপত্রই পাঠকের কাছে সম্বল। সেসব চিঠিপত্র একান্তই দরবারি দরকারে লিখিত বটে। তবে খানিক খুঁটিয়ে পড়লে মেলে ইতিহাসের ঝঞ্ঝামুখর ওই সময়ের উত্তাপ ও উষ্ণ শোণিতের চঞ্চল তরুণ নবাবের মনমানসিকতার পরিচয়। যা হোক, পূর্বোক্ত চিঠির দিন কয়েক পর, খোজা ওয়াজিদকে ১৭৫৬-এর ১ জুন মুর্শিদাবাদ থেকে লেখা তার আরেকটি চিঠি থেকে জানতে পাই, নবাবকে দামি পশমি কাপড় ও দুটি বহুমূল্য ঘোড়া উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিল ইংরেজরা। কিন্তু তিনি তা গ্রহণে সম্মত হননি, উল্টো ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ প্রত্যাখ্যানের হেতু কী? সিরাজ ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছেন, ইংরেজরা ‘না আমার নির্দেশ আমলে নিয়েছে, না আমার সঙ্গে উপযুক্ত বোঝাপড়া করে [বাংলায়] অবস্থান করছে...এসব কারণে আমি তাদের দেয়া ভেট গ্রহণ করব না...।’ নবাব জাফর খানের আমলে মেনে চলা শর্তে ফিরে যাওয়া ও নিজেদের দুর্গ ভেঙে ফেললেই একমাত্র ইংরেজ কোম্পানিকে তিনি ক্ষমা করবেন। ওই চিঠিতে সে কথা পুনর্ব্যক্ত করে সিরাজ কঠোর ভাষায় অতঃপর লিখেছিলেন, ‘[শর্তগুলো মেনে নিলে] আমি তাদের ভুলত্রুটি মাফ করে দেব এবং তাদের এখানে থাকার অনুমতি দেব। অন্যথায় আমি দ্রুতই পুরো জাতটাকে এখান থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব...।’ চিঠির শেষে ওয়াজিদকে বলেছেন, তার এ কথাগুলো যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ইংরেজদের জানিয়ে দেয়া হয়। তবে ইংরেজ কোম্পানি স্বভাবতই নবাবের কথা গ্রাহ্য করতে চাইছিল না। নবাব তাই তার পূর্বব্যক্ত সংকল্প অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখালেন। কাশিমবাজার থেকে কলকাতায় যাওয়ার পথে খোজা ওয়াজিদকে লেখা একটি তারিখবিহীন চিঠিতে পাই সেই প্রতিক্রিয়ার বিবরণ এবং তার ক্ষুব্ধ মনোভাবের প্রকাশ: ‘...আমি কাশিমবাজার [কুঠির] ইংরেজপ্রধান মি. ওয়াটসকে ধরে এনেছি (যার আচরণ কিনা মোটেই প্রধানসুলভ নয়) এবং তাকে হোসেন আলি বেগ খানের জিম্মায় দিয়েছি।...মহান আল্লাহর নামে কসম রেখে বলছি, আমি ইংরেজদের দেশে থাকাটা আর বরদাশত করব না...।’ কোম্পানিকে বাঁচাতে ব্রিটিশ সরকার দুই চতুর সেনাধ্যক্ষকে ১৭৫৬-এর অন্তে বাংলায় পাঠালে তাদের সঙ্গেও সিরাজউদ্দৌলার কিছু উত্তপ্ত চিঠি চালাচালি হয়েছিল। ওই দুই সমরাধিপতি লে. কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসনকে লেখা সিরাজের একাধিক চিঠির সন্ধান মেলে। ১৭৫৭-এর ২৩ জানুয়ারি ওয়াটসনকে লেখা চিঠিতে নবাব কড়া মেজাজে রীতিমতো সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘...আপনার এটা জানা আবশ্যক যে বাংলায় কোম্পানির প্রধান রজার ড্রেক তাকে পাঠানো আমার নির্দেশের বিপরীতে গিয়ে কাজ করেছে এবং আমার কর্তৃত্বের ওপর খবরদারি ফলিয়েছে।...আমি ও ব্যাটাকে শাস্তি দেব এবং দেশ থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব। ...যদি ইংরেজরা প্রকৃত বণিকের মতো আচরণ করে এবং আমার আদেশ মেনে চলে, তারা তাহলে হয়তো নিশ্চিন্তেই আমার কাছ থেকে অনুগ্রহ, নিরাপত্তা ও সাহায্য পেতে সক্ষম হবে। ...আপনি যদি ভেবে থাকেন আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ অঞ্চলে আপনাদের ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন, তাহলে যেটা ভালো মনে হয় তা-ই করুন...।’ শেষ বাক্যে রীতিমতো ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে দিয়েছিলেন সিরাজ। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জে জেতা যে আর তার হয়নি, তা তো সবারই জানা। খেলা অবশ্য অন্যদিকেও চলছিল। ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের সম্পর্ক যখন সাপে-নেউলে, তখন তার মনে হলো যে ডাচ কি ফরাসিসহ অন্য সব বিদেশি বণিকরা তার মিত্র হয়ে উঠতে পারে। অতঃপর সেই ভাবনা থেকে অন্য সব কোম্পানির দপ্তরে চিঠি পাঠাতে থাকলেন। ১৭৫৭-এর ৩০ জানুয়ারি চন্দননগরের ফরাসি কুঠির প্রধান এম রেনোঁকে নবাব গদগদ হয়ে লিখলেন, ‘...বণিকশ্রেষ্ঠ, প্রকৃত বন্ধুর উদাহরণ এম রেনোঁ, ফ্রেঞ্চ কোম্পানির ডিরেক্টর জেনারেলের প্রতি...সর্বদা আনন্দে থাকুন। শ্রেষ্ঠতম বণিকগোষ্ঠী [ফরাসি] এবং বিশ্বাসহীন ইংরেজদের মধ্যে শুধুই রয়েছে [পরস্পরের প্রতি] শত্রুতা ও ঘৃণা, এ আমি স্মরণে রাখি।...আমার শক্তি ও ক্ষমতার সহায়করূপী প্রিয় ভাই রাজা মানিক চাঁদের মাধ্যমেও আমি জেনেছি যে নিশ্চিতভাবেই এ শ্রেষ্ঠতম বণিকগোষ্ঠী আমাকে সাহায্য করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ...আপনি তো খাঁটি বন্ধুর উদাহরণ, আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনার শক্তিকে কাজে লাগান...।’ ফরাসি কোম্পানি নবাবের বিগলিত মনের বন্ধুতার আহ্বান গ্রহণ করেনি। তাদের কর্মকাণ্ডও কার্যত সিরাজের পক্ষে শেষমেশ কোনোভাবেই যায়নি। সিরাজউদ্দৌলার অবশ্য এমন মরিয়া হওয়ার কারণ নানাভাবেই তখন বিরাজমান ছিল। কারণ এর মাস খানেক আগেই সিরাজের দখলে থাকা ‘আলীনগর’-এর পতন ঘটিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম পুনর্দখল ও হুগলি দখলে নিয়ে সেখানে চরম লুটতরাজ চালিয়েছে ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ সেনাবাহিনী। খোদ ক্লাইভকে ১৭৫৭-এর ১ ফেব্রুয়ারি নবাবের পাঠানো চিঠিতে সেই ঘটনারই উল্লেখ মেলে, ‘...আপনি যেভাবে হুগলি দখল করেছেন, তা মোটেও বণিকোচিত নয়। বহু পণ্য সেখানে ধ্বংস ও গায়েব হয়েছে। ...আপনি নিশ্চয়ই জানেন, যুদ্ধের থেকে শান্তি উত্তম। কোম্পানির ব্যবসার উত্থান নাকি পতন ঘটবে, তা আপনার হাতেই রয়েছে। সে যা-ই হোক, আমি এ দু-কথা আপনাকে পাঠালাম ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গোলমাল এড়াতে...।’ ঘটনা যেদিকে যাচ্ছিল, তাতে সিরাজের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছিল। এমনকি ১৭৫৭-এর ৩ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভকে পাঠানো তার একটি চিঠিতে যুদ্ধের বদলে সমঝোতার কথাই অধিক পরিমাণে লভ্য। ক্লাইভের সঙ্গে ব্যবসা করা, এমনকি তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা যেমন সেই চিঠিতে আছে, তেমনি ক্লাইভকে একজন দূত পাঠানোর অনুরোধও তাতে রয়েছে। সিরাজ লিখেছিলেন, ‘...আল্লাহতাআলা ও নবীজির নামে শপথ, তাদের [ক্লাইভের দূত] সঙ্গে খারাপ কিছু করা হবে না। তারা আমার কাছে আপনার দাবিগুলো যথাযথরূপে তুলে ধরুক। আমি সেগুলো পূরণ করব। আমি তো জমিদারদেরও নির্দেশ দিয়েছি এই মর্মে যে তারা যেন কোনো ঝামেলা না করে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা করবেন না, আপনার ডেপুটিদের আমার কাছে নিরাপদে পাঠিয়ে দিন...।’ ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সিরাজউদ্দৌলার মনে দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল। বিষয়টা নজরে পড়ার মতো। সিরাজউদ্দৌলার নেতৃত্ব কার্যত বাংলার সরকারে ক্রমে ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে আসছিল। দুররানি সাম্রাজ্যের অধিশ্বর আহমদ শাহ দুররানি পাটনায় সেনা পাঠাচ্ছেন এবং তারা বাংলায় আসতে পারে এমন সংবাদ সিরাজের কানে এসেছিল। ১৭৫৭-এর ফেব্রুয়ারির কোনো এক তারিখে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে পাঠানো এক চিঠিতে সিরাজ লেখেন, ‘...দিল্লির সম্রাটের সেনাবহর এদিকের প্রদেশগুলোর দিকে এগিয়ে আসছে। এ গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমি পাটনার দিকে বহর নিয়ে তাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভাবছি। যদি আপনি এ জটিল সন্ধিক্ষণে আমার মিত্র হন এবং আমাকে সেনা দিয়ে সাহায্য করেন, তাহলে আমি আপনার অধীনস্থ বহরকে মাসে ১ লাখ রুপি করে দেব, যতদিন তারা আমার সঙ্গে থাকবে ঠিক ততদিন। দ্রুত জবাব পাঠান...।’ একই ভাবনা নিয়ে তিনি খোদ ক্লাইভকেও চিঠি লিখেছিলেন। ওই বছরের ৪ মার্চ লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘...নতুন সম্রাটের অগ্রবর্তী বাহিনী বাংলায় আক্রমণের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে, আর আমি ভাবছি আজিমাবাদের [পাটনা] দিকে রওনা হব। আপনি যদি এ লড়াইয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেন এবং আমার সঙ্গে রওনা হন, যতদিন আমার সঙ্গে আপনি থাকবেন ঠিক ততদিন আপনার সেনাদলের ভরণপোষণের জন্য আমি প্রতি মাসে লাখ টাকা দেব। দ্রুত এ বিষয়ে আপনার জবাব লিখে আমাকে পাঠান...’। দুররানির সেনাদল শেষমেশ বাংলায় আসেনি। আহমদ শাহ দুররানি শান্তি প্রস্তাব জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছেন এ কথা তিনি ক্লাইভকে চিঠিতে জানিয়েছেন খুব আনন্দের সঙ্গেই। এমনকি এ ঘটনার নেপথ্যে ক্লাইভ-সিরাজ যোগাযোগ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে এমন ধারণাও ছিল সিরাজের : ‘...আল্লাহর রহমতে আহমদ শাহ আবদালির থেকে শান্তি প্রস্তাবসংবলিত চিঠি আমার হাতে মাত্র এসেছে এবং আমি তাকে জবাবও পাঠিয়েছি।

আমার পাটনায় অগ্রবর্তী হওয়ার সিদ্ধান্তও বাতিল হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের প্রভাবেই যেন এ কল্যাণকর ঘটনাটি ঘটে গেল। ...আপনার সঙ্গে আমার এ বন্ধুত্ব আমি খুব উপভোগ করছি...।’ সিরাজউদ্দৌলার এসব চিঠিপত্রে যে আবেগনির্ভরতা ও দোদুল্যমানতার দেখা পাই, সেসবই সম্ভবত তার চূড়ান্ত পরাজয়ের জন্য দায়ী। ক্লাইভ-ওয়াটসনের প্রতি শুধু মীর জাফর নন, তিনিও কিন্তু মোহিত হয়েছিলেন। তাতে তার শেষরক্ষা হয়নি। বস্তুত ইতিহাসে ব্যক্তি সিরাজউদ্দৌলার লিখিত নেতিবাচক ‘ইমেজ’ সরিয়ে রেখে যদি তার নিজের লেখা চিঠিগুলোর দিকে তাকাই তাহলে এ কথা মনে হতে বাধ্য যে এ তরুণ নবাব রাজনীতি ও শাসনকার্যের কূটকৌশল সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন না। তা তিনি ব্যক্তি হিসেবে যেমনই হোন না কেন। চরমতম সন্ধিক্ষণে প্রতিপক্ষকে লেখা চিঠিতেও তিনি আবেগপ্রবণ, এমনকি নিজের দুবর্লতা প্রকাশের বেলায়ও ভারি দক্ষ। অন্যপক্ষে কূটনৈতিক দক্ষতায় ও গোপনীয়তা রক্ষায় ততটা নন। এতে আর যা-ই হোক নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল। সিরাজউদ্দৌলার চিঠিপত্র থেকে এটাই শিক্ষা নেয়ার।

লেখক : নন-ফিকশন লেখক