রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পর্যটন

ব্যবসা রক্ষায় করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে নতুন করে

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কবলে পড়েছে আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত। ডিসেম্বর মাস পর্যটনের সেরা সময়। ভ্রমণের উপযোগী আবহাওয়া ও স্কুল-কলেজ ছুটি থাকায় এ সময় তিল ধারণের জায়গা থাকে না কক্সবাজার, বান্দরবান, সুন্দরবন ও সিলেটসহ দেশের প্রধান পর্যটক এলাকায়। তবে এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো লোভনীয় অফার দিয়েও পর্যটক টানতে পারছে না। যানবাহনে অগ্নি সন্ত্রাসের আতঙ্কে বাইরে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না অনেকেই। পর্যটন সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটন খাতে খরা চলছে। পর্যটন গন্তব্যে এয়ারলাইন্স ও বাস টিকিট বিক্রিতে নেমেছে ধস। বেশি ছাড়ের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও পর্যাপ্ত গ্রাহক নেই হোটেল-রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এভাবে চলতে থাকলে পর্যটন খাতে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের পথে বসতে হবে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পর্যটকরা। তাদের অভিযোগ, এখন বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে পরীক্ষা শেষ। বছর শেষে সবাই দেশের পর্যটন এলাকাগুলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা নেন। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পরিবার নিয়ে তারা বের হতে ভয় পাচ্ছেন। তাই দাবি-দাওয়া আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিকল্প কিছু ভাবার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি-জামায়াত। এ নিয়ে ওইদিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকে টানা হরতাল-অবরোধ পালন করছে বিএনপি। সেই সঙ্গে গণসংযোগের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির এসব কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়ে আসছে জামায়াত। ফলে প্রতিটি কর্মসূচিতেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যমতে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৯৭টি বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় গণপরিবহন এবং ট্রাক-কাভার্ডভ্যান কম চলায় পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি জানাচ্ছে ‘বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের কারণে পর্যটন গন্তব্যে যেসব বাস যাত্রী পরিবহন করে, সেগুলোতে গড়ে ৭০ শতাংশ যাত্রী কমেছে। আর যাত্রী সংকটে বাসও চলছে কম। এতে পরিবহন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ গত ১৯ ডিসেম্বর সারা দেশে হরতাল পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত। এ কর্মসূচির প্রথম প্রহরে তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে মা ও শিশুসহ চারজন যাত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর অবরোধ চলাকালে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেললাইন কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাশের খালে গিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় একজন যাত্রী নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। হরতাল-অবরোধের কারণে গত নভেম্বর এবং চলতি মাসের প্রথম দিকে পর্যটন গন্তব্যগুলোতে যাত্রী তুলনামূলক কম ছিল বলে জানিয়েছে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলো। সংস্থাগুলো বলছে, ‘গত নভেম্বরে হরতাল-অবরোধে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী গড়ে ১৫ শতাংশ কম ছিল। বিশেষ করে পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেটে যাত্রী অনেক কমছে। হরতাল-অবরোধে সড়কপথে পরিবার নিয়ে ভ্রমণে বের হতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। আবার আকাশপথে উড়োজাহাজে ভ্রমণে যাওয়ার মতো সামর্থ্য অনেকেরই নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট ২০২০-এর তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল তিন শতাংশ। এছাড়া সে বছর এ খাতে মোট কর্মসংস্থান ছিল চার শতাংশ। দেশে পর্যটন মৌসুম সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। শীতের মাসগুলোয় থাকে ভরা মৌসুম। প্রায় ৫০০ হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট ছাড়াও দুই হাজারেরও বেশি খাবারের দোকান নিয়ে কক্সবাজার দেশের শীর্ষ পর্যটন স্থান। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ খাতে খরা চলছে বলে জানিয়েছেন হোটেলে কক্ষ না পেয়ে রাস্তায় রাত কাটালেন পর্যটকরা। এছাড়া অতীতে এমন সময় গেছে দিনের ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সড়কে যানজট তৈরি হতো। রাতেও বিচে লোকজন যেত। এবছর তার উল্টোটা হয়েছে। এ অবস্থায় পর্যটন শিল্প এবং এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের রক্ষায় কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।