ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে করোনার জেএন.১ ধরন

বাংলাদেশে আতঙ্ক নয়, চাই জনসচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বাংলাদেশে আতঙ্ক নয়, চাই জনসচেতনতা

করোনাভাইরাস সামাল দেওয়ার পর এখন ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জেএন.১-এর সংক্রমণ দেশটির গোয়া, কেরালাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে অন্তত ২১ জনের শরীরে এ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে সবাইকে আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের নতুন এই ধরন নিয়ে শঙ্কিত যা আগের সব ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। কোভিড-১৯-এর নতুন এই ধরন জেএন.১ সম্প্রতি ভারত ছাড়াও চীনসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়েছে। খবর দ্য হিন্দুস্তান টাইমস। গত ৮ ডিসেম্বর রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে তিরুবনন্তপুরম জেলার কারাকুলাম থেকে একজন আরটি-পিসিআর পজিটিভ আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়। ৭৯ বছর বয়সি নারী ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেসের (আইএলআই) হালকা লক্ষণ ছিল এবং কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন। এ ধরনটি আবারো বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের শঙ্কা ছড়িয়ে দিয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর কোভিড-১৯-এর নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় চীনে, যার নাম জেএন-১। এরইমধ্যে দেশটির অন্তত সাতজন রোগীর শরীরে ভাইরাসের নতুন এই ধরনটি শনাক্ত হয়েছে। এতে করে ফের ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। কোভিড-১৯-এর ভয়াবহ ধরন ওমিক্রনের নতুন এই উপধরনের মধ্যে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ অবস্থায় ওই ভাইরাসটিকে ‘আগ্রহের ধরন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এর আগে করোনাভাইরাসের নতুন একটি উপধরন বিএ-২.৮৬ শনাক্ত হয়েছিল যাকে জেএন.১ বলে ধারণা করা হতো। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাইরাসটি শনাক্ত হয়।

দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ সেন্টারের (সিডিসি) বরাতে জানানো হয়েছে, জেএন.১ এবং বিএ.২.৮৬-এর মধ্যে খুবই সামান্য পার্থক্য রয়েছে। চলতি ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে যে ক’জন কোভিড রোগী এই মুহূর্তে আছেন, তাদের ১৫-২৯ শতাংশের শরীরে রয়েছে জেএন.১ উপধরনটি।

এই ধরনটির পৃষ্ঠে মধ্যে থাকা স্পাইক প্রোটিন যা দেখতে ‘স্পাইক’ সদৃশ্য, এটি ভাইরাসটিকে মানুষে সংক্রামিত করে থাকে। সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে ধ্বংস ও অকার্যকর করতে পারে এমন ক্ষমতাসম্পন্ন টিকা এরইমধ্যে দেয়া শুরু হয়েছে। উপসর্গ * জ্বর * সর্দি * গলা ব্যথা * মাথাব্যথা * গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (পাতলা পায়খানাসহ বমি) সমস্যা রোগীদের মধ্যে উপসর্গ হিসেবে দেখা যেতে পারে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ রোগী হালকা শ্বাসযন্ত্রের উপসর্গগুলো অনুভব করেন, যা সাধারণত চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সেরে যায়। এর আগে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম সার্স- কোভিড-২ বা করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে করোনার এ ধরনটি পাওয়া গেছে। দ্রুত ছড়ানোর কারণে ডব্লিউএইচও এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছে। সংস্থার পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শীতকালে কোভিড এবং অন্য সংক্রমণগুলোর প্রকোপ বাড়তে পারে। উত্তর গোলার্ধে এরইমধ্যে আরএসভির মতো বিভিন্ন শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস এবং শিশুদের নিউমোনিয়ার হার বাড়তে দেখা গেছে। ডব্লিউএইচও বলেছে, কোভিডের জন্য দায়ী ভাইরাসটি শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে রূপ পাল্টেছে। এর কয়েকটি ধরনও তৈরি হয়েছে। মাঝে কিছুদিন বিশ্বজুড়ে ওমিক্রন ধরনের আধিপত্য দেখা গিয়েছিল।

তবে সংস্থাটি বলেছে, বর্তমানে এ করোনার ধরনটির সংক্রমণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কম এবং বিদ্যমান টিকাগুলোই এ ধরন থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেবে। যুক্তরাজ্যের হেলথ সার্ভিস বলেছে, বর্তমানে একটি পরীক্ষাগারে যতগুলো করোনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসছে, তার প্রায় ৭ শতাংশের জন্য জেএন.১ দায়ী।

শীতে প্রকোপ বাড়ার ঝুঁকি : ধারণা করা হচ্ছে, ওমিক্রনের আরেক উপধরন বিএ.২.৮৬ ধরনের তুলনায় জেএন.১-এর স্পাইক প্রোটিনের অতিরিক্ত পরিবর্তনের কারণে সব অঞ্চলে জেএন.১ দ্রুত ছড়াচ্ছে। বিএ.২.৮৬ ধরন থেকেই জেএন.১-এর উৎপত্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঝুঁকিসংক্রান্ত এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিশেষ করে, যেসব দেশে শীত মৌসুম শুরু হচ্ছে, সেখানে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত অন্য সংক্রমণগুলোর পাশাপাশি এ ধরনের কারণে সারস-কভ-২ (করোনাভাইরাস) এর প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে। ডব্লিউএইচও বলছে, টিকার কারণে যে ইমিউনিটি তৈরি হয়, তা দিয়ে জেএন.১ থেকে কতটুকু সুরক্ষা মিলবে, সে ব্যাপারে খুব বেশি প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে আগের ধরনগুলোর চেয়ে এ ধরনে সংক্রমণের কারণে মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ হচ্ছে বলে খবর জানা যায়নি। সংস্থাটি মনে করছে, স্বাস্থ্যের ওপর এ ধরনের প্রভাব নির্ণয়ের জন্য আরো বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

সংক্রমণ ও মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো হলো * জনাকীর্ণ ও বদ্ধ জায়গায় মাস্ক পরতে হবে। * কাশি বা হাঁচির সময় নাক ও মুখ ঢেকে রাখতে হবে। * কোভিড এবং টিকার নতুন নতুন তথ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে। * বিশেষ করে, যারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন। * অসুস্থ হলে বাড়িতে থাকুন। * লক্ষণ দেখা দিলে রোগ শনাক্তের পরীক্ষা করতে হবে। উল্লেখ্য, ৩ বছর ৯ মাস ১০ দিনে বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত ২০ লাখ ৪৬ হাজার ১৭০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) প্রথমবারের মতো তিনজনের করোনা শনাক্তের তথ্য জানায় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। করোনা শনাক্ত হওয়া ওই তিনজনের মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ ছিলেন। করোনা মহামরির শুরুতে সংক্রামণ রুখতে ‘লকডাউন’, ‘সাধারণ ছুটি’, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মতো নানান সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। দেশে এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে মোট করোনা শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। সরকারি হিসেবে করোনার সংক্রমণে দেশে মোট ২৯ হাজার ৪৭৭ জনের মৃত্যু হলো। শনাক্ত বিবেচনায় মোট মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশে মোট সুস্থ হয়ে সেরে উঠলেন ২০ লাখ ১৩ হাজার ৮৫৮ জন। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডও-মিটারের ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে করোনায় এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬০১ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৬৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ২৮৮ জন। ভাইরাসে মোট সংক্রমিত হয়েছেন ৬৯ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৭৪ জন।

পরিশেষে বলতে চাই, যেহেতু আমাদের বাংলাদেশে পরিবেশ দূষিত, তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। ধুলোবালি থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হবে।

হাত স্যানিটাইজ করতে হবে। একটা ভাইরাস দেহে থাকতে, আরেকটি প্রবেশ করলে তখন ওই ব্যক্তির সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়। এ জন্য ঘরেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।’ জনবহুল এলাকা, ভিড় থেকে শিশুকে যতটা সম্ভব দূরে রাখুন। কোভিডকালের মতোই মুখে মাস্ক এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর আবারো জোর দেওয়া উচিত। এই রোগ ছোঁয়াচে। সুতরাং, সাবধানতা অবলম্বন না করলে, বিপদ বাড়বেই। তাই শীতের এই মৌসুমে ঘোরাঘুরি, উৎসব, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। কিন্তু যেকোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উৎসব অনুষ্ঠান করতেই হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত