স্মরণীয়-বরণীয়

আলোকিত মানুষের নাম অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম

আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক-গবেষক ও দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নজরুল ইসলাম দুলাল

একজন আলোকিত মানুষের নাম অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম। তিনি ১৯৭৯ সালে কুমিল্লার বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ছিলেন। একজন রাজনীতিবিদের পাশাপাশি তিনি একাধারে আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক-গবেষক ও দেশবরেণ্য সমাজহিতৈষী। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

১৯২৬ সালে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশিমুল গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই খ্যাতিমান ব্যক্তির গর্বিত পিতার নাম মো. বন্দে আলী ও মাতা আতরুন্নেসা। স্বাধীনচেতা ও সাহসী এ রাজনীতিবিদের পিতা একজন সরকারি চাকরিজীবী ও মা ধর্মপরায়ণ গৃহিণী ছিলেন।

অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম ১৯৪৩ সালে ইউসুফ বহুমুখী কারিগরি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৪৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অবিভক্ত ভারতে মেধা তালিকায় ৮৫তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএ (পাস) উত্তীর্ণের পর ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এবং ১৯৬২ সালে আইন বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে তিনি ‘সোভিয়েত রাশিয়া, আফগানিস্তান ফেক্টস এন্ড ফিকশন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং তা বহুল আলোচিত হয়। তাঁর অন্যান্য Degree Functional English.’ ‘Advanced Essay, Principles of Commercial English. Fundamentals of Political English. ‘মৌলিক অর্থনীতি, ‘বাণিজ্যিক পত্র সংযোগ’, International law made   Easy. Standard Functional English. সোভিয়েত ইউনিয়ন : স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইত্যাদি। তার রচিত প্রতিটি গ্রন্থই তথ্যসমৃদ্ধ ও পাঠক সমাদৃত।

উপমহাদেশের এই খ্যাতিমান মেধাবী রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম স্কুল ও কলেজ-পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়নসহ বাণিজ্য, অর্থনীতি, আইন ও গবেষণালব্ধ অসংখ্য পুস্তক রচনা ও সংকলন করে বহুল আলোচিত হয়েছেন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তার সাহচর্য অধ্যাপক মফিজুল ইসলামকে বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৬ সালেই তিনি চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৫০ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামের আবু তোরাব হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

এরপর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার দায়ে সরকারি চাপের মুখে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং লাহোরের ‘দি পাকিস্তান টাইমস’র চট্টগ্রাম সংবাদদাতার কাজ করেন। তারই উদ্যোগে ও পরিচালনায় ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সরকার-বিরোধী বাংলা দৈনিক ‘আমার দেশ’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ৬ মাস পর সরকারি চাপের মুখে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ১৯৫৩ সালের গোড়ার দিকে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। এর আগে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি প্রথমে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। এ নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইস গ্রামের বঙ্গশার্দুলখ্যাত মেজর আবদুল গণি। পশ্চিম জার্মানীর বন শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান এবং সেখানেই তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৫৪ সালে অধ্যাপক মফিজুল ইসলামের উদ্যোগে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি এ কলেজের প্রথম উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং একই সালে তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার চট্টগ্রামের সংবাদদাতার কাজ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর প্রদেশব্যাপী ‘৯২-ক’ ধারা জারি হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তিনি মুক্তি পান। পুনরায় ১৯৫৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পুলিশ ধর্মঘটের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৯ মাস পর তিনি মুক্তিলাভ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থিরা বেরিয়ে এলে অধ্যাপক মফিজুল ইসলামও তাদের সাথে বেরিয়ে আসেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠিত হলে তিনি ন্যাপে যোগদান করেন এবং কুমিল্লা জেলা ন্যাপ’র সভাপতি হন। একই সালে বঙ্গশার্দুল মেজর আবদুল গণির আকস্মিক মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) উপনির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে অধ্যাপক মজিফুল ইসলাম ন্যাপের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় নবীন আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমীর হোসেনকে। নির্বাচনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের সব বাঘা বাঘা নেতারা বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ার বিভিন্ন জনসভায় যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু এ নির্বাচনে দলের প্রার্থীর পক্ষে ১৫-২০ দিন ব্যাপক প্রচার অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদিকে ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক মফিজুল ইসলামের পক্ষে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচার-প্রচারণা করেন। ১৯৫৮ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে অ্যাডভোকেট আমীর হোসেনের কাছে অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম সামান্য ভোটের ব্যবধানে (১ হাজার ৭৯৫ ভোট) পরাজিত হন।

অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম এনডিএফ’র কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৮-’৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

পরবর্তীতে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জাতীয় লীগ গঠিত হলে অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম তাতে যোগদান করেন এবং এক পর্যায়ে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৭০ ও ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জাতীয় লীগের লাঙ্গল প্রতীকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। এরপর রাজনৈতিক আর কোনো দলের সাথে সম্পর্ক রাখেননি তিনি। কুমিল্লার আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট আইনজীবী মফিজুল ইসলাম আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। এরই মধ্যে আইন পেশায় তার দেশব্যাপী খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অনেক কঠিন মামলার আর্জিও তিনি এমনভাবে সাজাতেন যে মামলাটি তার পক্ষে চলে আসত।

তিনি কুমিল্লা শহরের রানীর বাজার রাসস্থলী আশ্রমের বিপরীতে একখণ্ড জমি কিনে ‘বানী-বিথী’ নামে বাড়ি নির্মাণ করেন। তার ঘরে চার কন্যা জন্মলাভ করেন। তারা সবাই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই বাড়িটির আগের অবয়বও এখন আর নেই।

এখানে গড়ে উঠেছে নয় তলাবিশিষ্ট বিশাল ইমারত। শুধু নেই বিশাল মনের সেই মানুষটি। এমনিভাবে কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩টায় তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, চার কন্যা, আত্মীয়স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আগামী ২৬ ডিসেম্বর অধ্যাপক মফিজুল ইসলামের ৩২তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার বিস্মৃতির প্রতি সম্মানে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।