ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আর্থিক ভাবনায় হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)

মোঃ আতিকুর রহমান, সমন্বয়কারী (হিসাব), স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।
আর্থিক ভাবনায় হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)

১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠাতা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর আর্থিকবিষয়ক দর্শন সম্পর্কে জানতে গিয়ে বিস্মিত। মিশন প্রতিষ্ঠাতার আর্থিক দূরদর্শিতা কতটা সুদুর প্রসারী ছিল তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের পরতে পরতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার সাথে আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে যে একটি পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মিশন প্রতিষ্ঠাতা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) স্থাপন করছেন- যা আজও অমলিন। মানুষের জীবনে অর্থ একটি অপরিহার্য বস্তু, কিন্তু তার প্রয়োজনীয়তা, ব্যবহার, সংরক্ষণ ও আহরণ প্রক্রিয়া, সঠিক সাবলীল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে তার স্থায়ীত্ব ও বিস্তার।

কোরআনে মুসলমানদের ভোগ বিলাস, লোভ লালসা থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করা হয়েছে। তাই একজন মুসলমানের বড় অঙ্কের অর্থ সঞ্চয় বা জমা করা উচিত নয়, বরং যাদের প্রয়োজন তাদের মধ্যে তা বিতরণ করা শ্রেয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ বলেন ‘ব্যয় কর, আমি তোমাকে দান করব’। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর ডান হাত পরিপূর্ণ এবং দিনে ও রাতে উদারভাবে (ধন-সম্পদ) ব্যয় করলে (আল্লাহর সম্পদ) হ্রাস পাবে না। তেমনি আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মৌলিক নীতিতে- ১. জবাবদিহিতা, ২. ধারাবাহিকতা, ৩. স্বচ্ছতা, ৪. সুশাসন, ৫. ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ৬. সমন্বয়-সততার অঙ্গীকার ৭. ন্যস্ত দায়িত্ব, ৮. অ্যাকাউন্টিং মান/নৈতিক আর্থিক অনুশীলন, আধুনিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় উল্লেখিত মৌলিক নীতির প্রতিটি বিষয় মিশন পরিচালনা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) যে প্রয়োগ এবং নির্দেশনা দিয়েছেন তা বিস্মকর। আমরা যদি উল্লেখিত নীতিগুলোকে নিয়ে বিশ্লেষণ করি তবে বুঝতে পারব যে, তার জাগতিক ধ্যান-ধারনা কতটা প্রগাঢ় ছিল।

যা বহু বছর আগে উনি চিন্তা করেছেন ও প্রচলন করেছেন তা এখন আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার মৌলিক নীতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে আধুনিক বিশ্বে। একটি একটি করে যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাব তার চিন্তা কতটাই সুদূর প্রসারি। প্রতিটি মিশনের গঠনতন্ত্রে অর্থ সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট লিখিত নির্দেশনা থাকত এবং তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হতো। ১৯৫৮ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের গঠনতন্ত্রে অর্থ ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছ ধারণা আমরা পাই-

Money from the Bank or Post office will be withdrawn by the joint signatures of the General Secretary and the Treasurer, the Treasurer will receive money from the collectors and others, hand over money to the 49 General Secretary and the Joint Secretaries to the extent mentioned above and deposit the amount exceeding Rs. 45.00 to the Bank or Post Office within one month. He will have to keep an account. In any conflict or dispute regarding the transaction he will bring the matter to the notice of the President at once, the accounts of the Mission should be audited by an Auditor to be appointed by the Executive Committee at such interval as I decided by the General Bodz. ধরা যাক, প্রথমত: জবাবদিহিতা-১৯৫৯ সালের ৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের অধিবেশনে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘প্রত্যেক শাখা মিশন প্রতি তিন মাস অন্তর একটি কার্য বিবরণী আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ কেন্দ্র মিশনে পাঠাইবার জন্য অনুরোধ করা হউক এবং নলতা আহ্ছানিয়া প্রতিষ্ঠানের যে সকল মেম্বার এককালীন ৫০০ বা ততধিক টাকা দান করেন, তাহারা উক্ত প্রতিষ্ঠানের লাইফ মেম্বার হইবার অধিকারী হইবেন।’ দ্বিতীয়ত: ধারাবাহিকতা-প্রতিষ্ঠাতা মিশনের প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকে এর আর্থিক ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন, মিশন প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্নে তিনি অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রাথমিক সাধারণ মানুষের কাছে মিশনের স্বচ্ছতা ও আস্থা তৈরির জন্য, যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতেন তা হলো, ‘আমরা দ্বারে দ্বারে মুষ্টি ভিক্ষা করি এবং মুষ্টির চাল বিক্রি করে শিক্ষকের বেতন দেই, শ্রমিক বেশে স্বয়ং রাস্তঘাট প্রস্তুত করি, নামাজ শিক্ষার ব্যবস্থা করি, মিলাদ শরিফের প্রচলন দ্বারা রোগ-শোক প্রশমিত করি। দুঃস্থ ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করি ইত্যাদি। মিশন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে সদস্যদের চাঁদার হার সদস্যদের ইচ্ছাধীন হলেও কেউ কেউ স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। সদস্যদের চাঁদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চাঁদার পরিমাণ মেম্বরগণের ইচ্ছাধীন। মাসে এক পয়সা হইতে তদূর্ধ্ব গৃহীত হয়। উক্ত চাঁদা দ্বারা মিলাদ শরিফ পাঠ, পীড়িতের সেবা ও রাস্তাঘাট প্রস্তুত করা হয়ে থাকে’। তিনি প্রতিনিয়ত সদস্যদের কাছে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য পত্র দিতেন এবং কখনো কখনো তিনি ভক্ত-অনুরাগীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতেন। আবার যথাসময়ে অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখেছিলেন।

স্বচ্ছতা ও সুশাসন : আধুনিক বিশ্বে স্বচ্ছতা ও সুশাসন বিষয় সোচ্চার উক্ত বিষয় প্রতিষ্ঠাতা নেয়া পদক্ষেপগুলো লক্ষ্যনীয় মিশনের গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ঠভাবে অডিট করানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় স্বচ্ছতা ও সুশাসনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেছেন। চট্টগ্রাম মিশনের সেক্রেটারি ডা. কাজী আব্দুল মোনায়েমকে এক পত্রে তিনি লেখেন ‘আশা করি ইহার মধ্যে Audit -এর আপত্তিগুলো ভঞ্জন করতে চেষ্টা করবেন। ... সর্বদা মনে রাখবেন মিশনের দায়িত্ব অতি গুরু এবং মিশন খোদারই একটি প্রধান দান।’ তিনি নিয়মিতভাবে হিসাব সংরক্ষণ করতেন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে দিতেন। অর্থ সংগ্রহের সময় মানি রিসিট ব্যবহার নিশ্চিত করার ও তিনি নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা : মিশনের আর্থিক ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে তিনি দানের অর্থ অবচয় না করে সঞ্চয়ের তাগিদ দিয়েছেন এবং এর পাশাপাশি উদ্বৃত্ত টাকা পোস্টাল ব্যাংকে জমা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এবং মিশনের গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ বিষয় একটি উদাহরণ হলো ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের এবং সাতক্ষীরা পিপলস অ্যাসোসিয়েসন ট্রেজারার জনাব মুনাসেফ আলীকে তিনি লেখেন, ‘বাবা হিসাব audit করবে, টাকা-পয়সা সম্বন্ধে কাহারও মনে সন্দেহের উদ্রেক যেন না হয়। পোস্টাল ব্যাংকে জমা রাখো, সদ্ব্যয়ের কড়া ক্রান্তি হিসাব রাখো আর সবাইকে দেখাও।‘

সমন্বয়-সততার অঙ্গীকার ও ন্যস্ত দায়িত্ব : মিশন প্রতিষ্ঠাতা মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাহায্য প্রার্থী হয়েছেন। সব মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা, সততা, প্রতিটি অর্থ ব্যয়ের হিসাব ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি নারী পুরুষ, ধনী-গরিব, সব ধর্মে, শ্রেণি পেশার লোকদের একই ছাতার নিচে আনতে সামর্থ্য হয়েছিলেন। সবার প্রচেষ্টায় পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনে পথ পরিদর্শক হিসাবে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ন্যস্ত করেছিলেন। নলতা আহ্ছানিয়া প্রতিষ্ঠানের ২৮ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণে কতিপয় প্রস্তাব প্রদান করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘প্রত্যেক মিশনকে জাকাত-প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে এবং জাকাত সংগ্রহের জন্য একেকটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করতে হবে’। জাকাত সংগ্রহের কমিটি গঠনের ধারণার মধ্যে স্বচ্ছতার বিষয়টি অগ্রগণ্য এবং সবাই মিলে দায়িত্ব বণ্টন করা যাতে সবার সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা যায়। সর্বোপরি মিশন গঠনতন্ত্রে কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারনা পাওয়া যায়। অ্যাকাউন্টিং মান/নৈতিক আর্থিক অনুশীলন : তিনি নিয়মিতভাবে হিসাব সংরক্ষণ করতেন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করে দিতেন। অর্থ সংগ্রহের সময় মানি রিসিট ব্যবহার নিশ্চিত করারও তিনি নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।

মিশন প্রতিষ্ঠাতার আর্থিক বিষয়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। তিনি ব্যক্তি জীবনে যেমন বিষয়টি চর্চা করেছেন, ঠিক তেমনি মিশনের কর্মকাণ্ডে চর্চা করেছেন। মিশনের কাজের জন্য মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার বিষয়ে তার আর্থিক ব্যবস্থাপনা অন্যতম বলে প্রতীয়মাণ হয়। তিনি কাউকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেননি। সূত্র : ইকবাল মাসুদ লিখিত আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা ও মানব কল্যাণের আত্মদর্শন

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত