ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অপ্রতিরোধ্য বাজার সিন্ডিকেট

আইনের অভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম
অপ্রতিরোধ্য বাজার সিন্ডিকেট

কারণে-আকারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বড় সংকট। দাম যখন বাড়তে থাকে তখন একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়ে। নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্যের দামও। সব কোম্পানিই একের পর এক বাড়াতে থাকে তাদের পণ্যের মূল্য। কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাম বাড়ে সিন্ডিকেটের কারণে। আর এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে দেশে শক্তিশালী কোনো আইন নেই। বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমাদের দেশের পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। বাজারে এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইনের বড় দুর্বলতা রয়েছে, যা আছে, তারও প্রয়োগ কম। আবার কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ নির্ধারিত রয়েছে। যে কারণে বারবার বেপরোয়া হয়ে উঠছেন ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লুটে নিচ্ছেন অবৈধ মুনাফা, যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। বর্তমান আইনে কারসাজি করে কোনো পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর সরাসরি লঙ্ঘন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য প্রতিরোধে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী, কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা বেশি মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। ভোক্তাধিকারের যে আইন আছে, সে আইনের মধ্যে তাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার দেওয়া আছে। তবে মামলা করার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি। ফলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাজার তদারকিতে ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় তৎপরতা সবচেয়ে বেশি হলেও এ আইনে বিচার শেষে সাজা হয়েছে, এমন উদাহরণ কম। বাজারে কোনো পণ্য অধিক দামে বিক্রির প্রমাণ মিললে এক-দুই হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই পরিমাণ জরিমানা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীর কিছু সময়ের অবৈধ মুনাফার সমান। এছাড়া আইনের অন্য ধারারও তেমন প্রয়োগ নেই। এ পরিস্থিতিতে প্রচলিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধন ও সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার- এমনটাই জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন ‘সিন্ডিকেটগুলো সব সময় বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ খোঁজে। এসব অবৈধ কারবারি চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে আমরাও সদা সক্রিয়। সেজন্য এ আইন অনেক ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বাজার তদারকির ক্ষমতা থাকলেও তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ, শুধু জরিমানা করতে পারে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের বক্তব্য হচ্ছে ‘আমরা কাউকে কারাদণ্ড দিতে পারি না। সেক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর মামলা করতে হবে। সেখানে কারাদণ্ড হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা চাইলে কারাদণ্ড দিতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে বিচারিক ক্ষমতা দিলে ভালো হয়। এখন বাজারে কোথাও সিন্ডিকেট কাজ করছে, কোথাও মুদ্রাস্ফীতির পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে অতি মুনাফালোভীদের সক্রিয় করা হয়েছে। ক্রেতা প্রতারণার নানা ক্ষেত্র এখন বাজারে। সেক্ষেত্রে আইন আরও কার্যকর প্রয়োজন। কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। গত অক্টোবরে ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিসংক্রান্ত মামলায় দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। প্রতিযোগিতা আইনের ১৫ ধারায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে কোম্পানিগুলো রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেছে। দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, বড় ব্যবসায়ী বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠাগুলো বাজারে একচেটিয়া অবস্থানের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। কোম্পানিগুলো প্রচলিত প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করে বাজারে কর্তৃত্বমূলক অবস্থা বজায় রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা কমিশন এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভোক্তারাও। তারা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এই সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে সিন্ডিকেট ও মজুতকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, এমনকি যাবজ্জীবন এবং সর্বনিম্ন ১৪ বছরের সাজা থাকার পরও কোনো ধরনের পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। আইনে বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) অধীনে একটি সাব-কমিটি থাকার কথা, যে কমিটি বাজার মনিটরিং করবে। এরকম আইনে অনেক কিছু আছে। কিন্তুকার্যকর কিছু দেখা যায়না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুত সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। সেটা প্রয়োগে ভোক্তা অধিদপ্তরের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নিতে পারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তারা মজুতদারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। এছাড়া কোনো এলাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) কিংবা যে কোনো সরকারি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বা এসিল্যান্ড ব্যবস্থা নিতে পারেন। ব্যবসায়ীরা বিশৃঙ্খলা করলে সেক্ষেত্রে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে মামলা করা যেতে পারে। তবে যা-ই হোক না কেন ব্যবসায়ীরা যদি অধিক মুনাফার জন্য পণ্যের মূল্য অকারণে বাড়িয়ে দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত