বাতাসে বিষ

ভয়াবহ হয়ে উঠছে জনজীবন

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। বিষিয়ে উঠছে জনজীবন। শিল্প, যানবাহন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নগরায়ন বায়ুদূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। বায়ুতে ক্ষতিকারক উপাদান বা পদার্থ মেশার ফলে বায়ুদূষণ হয়। এতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিসহ পরিবেশ ও সম্পদ নষ্ট হয়, পশুপাখি ও ফসল ইত্যাদির ক্ষতি হয়। এমনকি বায়ুদূষণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজনস্তর পাতলা হয়ে যায়, যার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। দূষিত বায়ুর কারণে সর্দি-কাশি, এলার্জি, ফুসফুসের অসুখ, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি, নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, মানসিক অবসাদ, মাথাধরা, ঝিমুনি, স্মৃতিভ্রষ্ট, ক্যান্সার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞমহলের মতে, পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয়। এখানে পরিবেশ দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন। পরিবেশ সচেতনতা এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবের জন্য উন্নয়ন ও পরিবেশ দূষণ পরস্পরের কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরের বাইরের দূষিত বাতাস আমাদের আয়ু গড়ে প্রায় তিন বছর পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে, যা আগের যে কোনো গবেষণা ফলাফলের চেয়ে বেশি এবং ধূমপানের ফলে যে পরিমাণ আয়ু কমে তার চেয়েও বেশি। গবেষকদের দাবি, বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে যত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, তার ১৫ শতাংশের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বায়ুদূষণের প্রভাব। পূর্ব এশিয়া বায়ুদূষণের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। গবেষকদের পর্যালোচনা অনুযায়ী দেখা গেছে, ২৭ শতাংশ করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে দূষিত বাতাস। ইউরোপের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ১৯ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ১৭ শতাংশ। বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়, তার মধ্যে বায়ুদূষণ অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জনই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বেশিমাত্রায় দূষিত বায়ু ব্যবহার করে। বায়ুদূষণের ফলে ২৪ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষের হৃদরোগ, ২৫ শতাংশ স্ট্রোক, ৪৩ শতাংশ ফুসফুসে রক্তচাপ এবং ২৯ শতাংশ ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে থাকে। দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা আবার প্রথম স্থান অধিকার করেছে। সম্প্রতি (২২ ডিসেম্বর ২০২৩) ঢাকায় চলতি বছরের সর্বোচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণ ছিল। ওই সময়ে বায়ুদূষণে বিশ্বের ১০০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের বাতাসের মান সূচকে ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’-এ (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ৪৪০। এ স্কোরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বলে গণ্য করা হয়। গত ২৩ জানুয়ারি সকালে বায়ুর মান সূচকে পরিমাপ করেছে ঢাকা ২৯৩ স্কোর, ২৯১ ও ২১৬ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় উজবেকিস্তানের তাসখন্দ এবং তৃতীয় স্থানে ছিল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এবং এ বছর জানুয়ারির শুরু থেকে একাধিকবার তালিকার শীর্ষে ছিল ঢাকা। বায়ুদূষণে অন্য দেশের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা বারবার শীর্ষে চলে আসছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, জানুয়ারি মাসে বছরের ৩০ শতাংশ বায়ু দূষিত হয় এবং মোট বায়ুদূষণের প্রায় ৬০ শতাংশ বায়ু শুষ্ক মৌসুমে দূষিত হয়। আইকিউএয়ারের মানদ- অনুযায়ী, স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ বলে ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু; স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে যেভাবে বায়ুদূষণ হচ্ছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা কেন্দ্র ‘হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন’-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে শুধু ভারতেই ১ লাখ ১৬ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সাব সাহারায় এ সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার। গবেষণায় জানা যায়, এসব শিশুরা জন্মের একমাসের মধ্যেই মারা গেছে। গর্ভাবস্থায় মায়েরা বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আসার কারণে শিশুদের ওজন কম হয় এবং প্রি-ম্যাচিওর শিশুর জন্ম হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের প্রধান ড্যান গ্রিনবাউম সতর্ক করে দিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব সাহারায় জন্ম নেওয়া শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের মতে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যায়। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ৪৬ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই ১০ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যায়। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুঝুঁকির কারণ হিসেবে বায়ুদূষণের স্থান হয়েছে চতুর্থ স্থানে। বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে মারা গেছে ৬৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন। সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১৯ সালে বায়ুদূষণের কারণে ২১ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে ভারতে ১৬ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ এবং নেপালে ৪২ হাজার ১০০ মানুষের মুত্যু হয়েছে। গবেষকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ আউটডোর পিএম ২ দশমিক ৫ স্তরে থাকা শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইউনিসেফের এক গবেষণা অনুযায়ী জানা যায়, বিশ্বের ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ুবেষ্টিত এলাকায় বাস করে। এর মধ্যে ২২ কোটি শিশু দক্ষিণ এশিয়ায়। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর পাঁচ বছর বয়সী ৬ লাখ শিশু মারা যায়। বায়ুদূষণের ফলে শিশু ও বৃদ্ধরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ুমন্ডল পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এয়ার ভিজুয়্যাল’-এর এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম রয়েছে শীর্ষে। বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ শীর্ষক ২০১৯ সালের রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষই এমন সব অঞ্চলে বাস করে যেখানকার বায়ু সুস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী বিশ্বের যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে, তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। একই পরিস্থিতি পাকিস্তান, ভারত, চীন, নাইজেরিয়া এবং মেক্সিকোতেও। তাছাড়া দূষিত বায়ুর কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হওয়া শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে এখানে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বায়ুদূষণে মারা যায়। প্রথম চারটি দেশের মধ্যে ছিল চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে সবচেয়ে দূষিত বায়ু ছিল নেপালে। এরপর ছিল ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। সংস্থাটির মতে, স্বাস্থ্যকর বায়ু নিশ্চিত করলে সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে বাংলাদেশ। জন্ম নেওয়া শিশুদের গড় আয়ু তখন ১ দশমিক ৩ বছর বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছে, শুধু ঢাকা নয়, এর আশপাশের শহরগুলোতেও বাতাসে দূষণের মাত্রা চরম অস্বাস্থ্যকর। এরকম উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আমেরিকার সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের বায়ুদূষণ কবলিত ১৪টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ঢাকা। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এ দূষণ কমানোর জন্য কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা আদৌ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে ফুসফুস, ক্যান্সার এবং ক্রনিকজনিত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে এবং কঠিন হুমকির মুখে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। বায়ুদূষণ রোধে আমাদের অবশ্যই কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য সবার আগে দূষণের উৎসগুলি চিহ্নিত করে দূষণ কমিয়ে আনতে হবে। অভিজ্ঞমহলের মতে, বায়ুদুষণ রোধে বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। ইটের ভাটা নিয়ন্ত্রণ করে সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করতে হবে। প্রয়োজনে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। যানবাহনজনিত দূষণ ঠেকাতে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বাস্তবিক অর্থে বন্ধ করতে হবে। সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে এবং স্বল্পসময়ে সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখা যাবে না। পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক ও উন্নত করতে হবে এবং যেখানে-সেখানে যাতে বর্জ্য উন্মুক্তভাবে পোড়ানো না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে বায়ুদূষণ বন্ধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষ থেকে নামতে হলে সরকারি সংস্থাগুলোকে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের উচিত হবে গবেষণা করে বের করা- কত দ্রুত এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়। এটি প্রতিরোধ করা এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে এখনই এগিয়ে না এলে সামনের দিনগুলোতে আরো ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।