মানুষ সামাজিক জীব। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করে আসছে। দলবদ্ধভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্য ছিল বন্য হীংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আরও একটি উদ্দেশ্য হলো, মানুষ একা বাস করতে পারে না। সে অন্যের সাহচর্য আশা করে। যদিও তখনো ভাষা আবিষ্কার হয়নি। যখন ভাষা এলো মানুষের মুখে তখন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষের সাহচর্যে থাকতে শুরু করল। আজ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মতবিনিময় হয় এবং তাতে মন হালকা হয়। ভালো লাগে। একটা সময় প্রযুক্তির ছোঁয়া ছিল না। হাতে হাতে দামি মোবাইল ফোন ছিল না। ডিশ অ্যান্টেনা ছিল না। মানুষে মানুষে দূরত্ব ছিল না। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আজ প্রচণ্ডরকম ব্যস্ত। কাজ না থাকলেও হাতের মোবাইল ফোনে চোখ থাকছে। একাকিত্ব কখন আসে? কেন আসে? মানুষ কি আসলেই একা? মানুষের একাকিত্ব এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে অনেকেই আজ নিঃসঙ্গ বোধ করছে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের হাজার হাজার বন্ধু আছে। তাদের সাথে কথা বলি। তবুও আমরা একা। এই একাকিত্ব থেকে জন্ম হচ্ছে বিষন্নতার। বিষন্নতা এখন ভয়ানক ব্যাধি। আমাদের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। আমরা সাধারণত তা বুঝতে পারি না। যখন বুঝি তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। মাঝে মধ্যেই মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার খবর আসে। দেখা যায় এর পেছনে রয়েছে ভয়ানক বিষণ্ণতা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিগহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির (বিওয়াইউ) জুলিয়ান হোল্ট-লান্সটাড বলেন, একাকিত্বের ক্ষতিকর দিকগুলোকে স্থূলতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার।
গবেষকরা জানান, বৃদ্ধ বয়সে বেশিরভাগ মানুষ একা হয়ে যান আর তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে বেশি। তবে তরুণ বয়সে যারা একাকিত্বে ভোগেন তাদের মধ্যে মৃত্যুর আশঙ্কা বৃদ্ধদের থেকেও বেশি থাকে। একাকিত্ব এখন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা তা টের পাচ্ছি না। এত ব্যস্ত জীবনে আমরা একা! জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে যখন না চাইলেও একা থাকতে হয়। হয়তো সারা জীবনের জন্য নয় তবুও যতটুকু সময়ই একা থাকতে হয়, হয়তো মাস বা বছর বা দীর্ঘসময় ধরে। আবার কখনও কখনও আজীবনই একাকী। একাকী বোধ করা ব্যক্তি চারপাশ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। ধীরে ধীরে সে আরও একা হয়ে যায়। বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে একসময় জীবনের প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো পথ। জানা যায়, কমিয়ে দিচ্ছে মানুষের সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা। একাকিত্বে ভোগা মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে হৃদরোগ, ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির মতো রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একাকিত্ব এখন নিজেই বড় একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে এটি। কেউ কেউ আবার একাকিত্বকে ভবিষ্যতের মহামারি হিসেবেও আখ্যা দিচ্ছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে বলেছে, একাকিত্ব দিন দিন মানুষের ভয়ংকর স্বাস্থ্য সংকট হয়ে উঠছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘মানুষ যখন বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, তখন এই সামাজিক যোগাযোগের অনুপস্থিতি আমাদের দেহমনে একটা স্ট্রেস, চাপ সৃষ্টি করে। এই স্ট্রেস, এই চাপ, আমাদের স্ট্রেস-হরমোন কর্টিসলের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। শরীরে এক ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা শরীরে নানা রোগকে স্বাগত জানায়। মানুষকে ঠেলে দেয় অকালমৃত্যুর দিকে। অর্থাৎ একাকীত্ব এখন একটি মানসিক রোগ যা ধীরে ধীরে মানুষের মনকে দগ্ধ করে। কাছের মানুষও তার এই অবস্থা বুঝতে পারে না। সে এক সময় এতটাই মানসিক চাপে চলে যায় যেখানে সে জীবনের বিষয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিগহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির (বিওয়াইউ) জুলিয়ান হোল্ট-লান্সটাড বলেন, একাকিত্বের ক্ষতিকর দিকগুলোকে স্থূলতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহামারি বিশেষজ্ঞ মেলোডি ডিং বলছেন, ‘একটি সাধারণ ধারণা থেকে বলা যায় যে, প্রায় ১২ জনের মধ্যে একজন এমন এক স্তরে একাকীত্ব অনুভব করে যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে তাকে পরিচালিত করতে পারে। একাকীত্ব নিয়ে স্ট্যাটিসটা গবেষণা ডিপার্টমেন্টের একটি তথ্যে জানা যায়, একটি বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক একাকিত্বের অনুভূতি অনুভব করেছেন। ব্রাজিলের সবচেয়ে বেশি শতাংশ লোকের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে, ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা ঘোষণা করেছেন যে, তারা প্রায়ই বা কখনও কখনও একাকী বোধ করেন। তুরস্ক, ভারত এবং সৌদি আরব অনুসরণ করেছে, ৪৩ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা অন্তত কখনও কখনও একাকিত্বের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। বিপরীতে, নেদারল্যান্ডস, জাপান, জার্মানি এবং রাশিয়া সাক্ষাৎকারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অংশ নিবন্ধন করেছে যারা একাকী অনুভব করেনি। যুক্তরাজ্য ও জাপানে একাকীত্ববিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে। সারা পৃথিবী এখন একাকীত্ব নিয়ে ভাবছে। বিভিন্ন বয়সেই মানুষ একাকীত্ব বোধ করতে পারে। তবে বৃদ্ধ বয়সে মানুষ একাকীত্ব বোধ করে সবচেয়ে বেশি। উন্নত বিশ্বে একাকীত্ব দূর করার জন্য রোবট সঙ্গী রয়েছে। বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন, পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সংস্থার করা যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৩-১৯ বছর বয়সি শহুরে ছেলেমেয়েদের ৬০ শতাংশের বেশি মাঝারি থেকে তীব্র মানসিক চাপে ভোগে। এই স্ট্রেস বা মানসিক চাপের ফলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। যেমন, নাগরিক এই কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ স্থূলতা এবং বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভোগে। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ১৫টি সিগারেট খেলে যে ক্ষতি হয় শরীরের, একাকীত্ব ঠিক ততটাই ক্ষতি করে। দীর্ঘদিন ধরে এই একাকীত্বে ভুগতে থাকলে সেটা মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকারক। মানুষ কিন্তু একা ছিল না এবং এখনও নেই। মানুষের মানসিক পরিবর্তন বা মনের দিক থেকে নিজেকে আলাদা মনে করাই এর মূল কারণ।
নানা ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতা এর জন্য দায়ী। ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। তাছাড়া আধুনিক জটিল ডিভাইসগুলো যা তরুণদের প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করছে সেসবও দায়ী। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তরুণ-তরুণীরা এসব ডিভাইসে ব্যয় করছে। তারা উচ্ছ্বল হয়ে মাঠে খেলাধুলা করছে না। বাবা মা’র কাছ থেকে দূরে থাকছে অথবা বাবা-মা নিজেদের কাজের ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সময় দিতে পারছে না। ভাই-বোনের মধ্যে আন্তরিকতা নেই। বন্ধুত্ব হয়েছে ডিজিটাল। সেই উদ্দামতা নেই। এসবই মানুষকে প্রচণ্ডভাবে একা করে দিচ্ছে।
যা একসময় ডিপ্রেশনে রূপ নিচ্ছে। পরবর্তীতে প্রেম এবং চাকরিবিষয়ক জটিলতা জীবনে যোগ হচ্ছে। এসব কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা অনেকের মধ্যেই থাকছে না। কারণ তাদের আত্মবিশ্বাসের প্রচণ্ডরকম অভাব তৈরি হচ্ছে। এভাবেই একাকীত্ব জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে নিরবে।