ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমার উপলব্ধিতে হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এঁর ব্যাধিভাবনা

ডা: নায়লা পারভীন, সহকারী পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস)স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।
আমার উপলব্ধিতে হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এঁর ব্যাধিভাবনা

সামাজিক কর্ম, শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা বিস্তারের কাজে হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও দেশের বাইরে অনেক স্থানেই অবস্থান করেছেন। এ সকল স্থানে কাজের ফাঁকে তিনি ভক্ত-সতীর্থদের আধ্যাতিকভাবে আল্লাহ ও রাসূলের বাণীতে আসক্ত করে জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য উৎসাহিত করিতেন।

তার মতে, জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য শুধু শরীর ঠিক রাখলেই হবে না; যে কোনো সৎ কাজে আত্মনিয়োগ করতে হলে শরীরের পাশাপাশি মনকেও সঠিকভাবে লালন-পালন করতে হবে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে রোগ সারাবার জন্য যেমন ওষুধের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি মনের পরিচর্যার প্রয়োজনও অনেক। মনের পরিচর্যা করার জন্য ভালো চিন্তা, ভালো কাজ করার পাশাপাশি ভালো সঙ্গী অথবা ভালো বন্ধুরও প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করতেন।

চিকিৎসা দ্বারা শারীরিক সুস্থতা ঘটলেও মানসিক পীড়ার লাঘব ঘটে না- তার জন্য প্রয়োজন বন্ধু বর্গের অকাতর শুশ্রষা ও ভক্তিমাখা ভলোবাসা। কখনো কখনো বন্ধু বর্গের ভক্তিমাখা ভলোবাসা ও শুশ্রষা আশায় শারীরিক যন্ত্রনা দীর্ঘতর হলেও তাতে আপত্তিকর কিছু নাই বলেও তিনি মনে করিতেন। একইসাথে আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত সবার জন্য দয়াময় আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পাওয়া যায় বলেও তিনি ভাবতেন। যা শুধু বন্ধুবর্গের সাহচার্যদ্বারা অর্জন সম্ভব না, সেখানে খোদার প্রতি আসক্তি ও শ্রদ্ধা দ্বারা নিরাময় হতে পারে তিনি মনে করতেন। হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর উপরোল্লেখিত ভাবনা থেকেই আমরা বুঝতে পারি যুগ যুগ ধরেই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির প্রয়োজনীয়তা ছিল। বর্তমানে আমরা এই বিষয়টি নানাভাবে উপলব্ধি করছি। শারীরিক পীড়া বা যন্ত্রনা চোখে দেখা যায় বিধায় আমরা তা উপশম করার কাজে লিপ্ত থাকি ও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মানসিক পীড়া অত্যন্ত কঠিন, যা চোখে দেখা তো দূরের কথা উপলব্ধি করাও অন্যের জন্য কষ্টসাধ্য।

এ কারণে হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) পরামর্শ দিয়েছেন, মানসিক প্রশান্তির জন্য আমাদের আত্মচেষ্টা থাকতে হবে এবং দয়াময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ভক্তদের কাছে লেখা তার বিভিন্নপত্রে তিনি লিখেছেন, রোগাক্রান্ত হলে বিচলিত না হয়ে তাকে আল্লাহর দেয়া আশীর্বাদ মনে করে রোগ যন্ত্রনা লাঘব করার চেষ্টা করতে হবে। লেখনির মাধ্যমে দেয়া সেই পরামর্শ নিজের জীবনে পরিপালনের কথাও আমরা জানতে পারি। তিনি কখনো ব্যাধিকে কুআখ্যায় আখ্যায়িত করেননি বা জ্বরা থেকে তিনি দূরে পালিয়ে যাননি।

জ্বরার মাধুর্য ও পীড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করার মাধ্যমে তিনি দয়াময়কে চিনিবার চেষ্টা করেছেন। তার জীবনের বিভিন্ন পর্বে দেখা যায়, তিনি জ্বরা ব্যাধিতে বিচলিত হতেন না বরং তাকে আহ্বান করতেন খোদাতায়ালার দয়া হিসাবে। এই ভাবনায় তিনি বলেছেন ‘জ্বরা-ব্যাধি বড় বাধ্য; বাচিয়া থাকিতেই দরবারে সংবাদ পৌঁছাইয়া দেয়’। এই কথার মর্ম অনেক গভীর যা শুধু উপলব্ধি করতে হয়। মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতা যাই হোক না কেন, একজন পীড়িত ব্যক্তির প্রার্থনা খুব দ্রুত খোদাতালার দরবারে পৌঁছে যায়। যারা সুস্থ বা ধনী তারা তো এই সাহায্য ভিক্ষা করে না। শুধু ব্যাধি ও জ্বরাতে আছেন যারা তারাই তো দয়াময়ের আশীর্বাদ করার সুযোগ পান। তাই ব্যাধিকে আল্লাহর প্রদত্ত আশীর্বাদ মনে করে এর মধ্যে প্রীতি ও দয়া খুঁজে পেতেন তিনি। নিজেকে তিনি এর থেকে বঞ্চিত করতে চাইতেন না, বরং একে দয়াময়ের তুষ্টি লাভের সুযোগ বলে মনে করতেন। একপত্রের মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেন, ব্যাধির জন্য এত দুশ্চিন্তা কেন? যে ব্যাধিকে সাধুগণ আদরে বরণ করিয়া লন, যাহাকে সাধু মহাজনগণ প্রিয়তমের মহাদান মনে করেন, তাহা পাইয়া এত ব্যস্ততা কেন? ভাই একবার এসো প্রাণে আলিঙ্গন করি, ব্যাধিতে ব্যাধিতে মিলিত হইয়া মহাব্যাধিতে পরিণত হউক, আর আমাদের যুক্ত রোগের কৃতজ্ঞতা মহাপ্রভুর দরবার পর্যন্ত উত্থিত হউক। হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ব্যাধিকে জীবনের অনুসঙ্গ মনে করতেন। তার লিখনিতে বলেছেন, ব্যাধিতে আমার উৎপত্তি, ব্যাধিতেই আমার তুষ্টি, মনে হয় ব্যধিতেই আমার সমাপ্তি। তাই ইহাকে আমি আলিঙ্গন করি, সতত পূজা করি। হৃদয়ের অন্তসূরে আশ্রয় দেই। তার মতে ‘শারীরিক বা মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেই সুযোগ বেড়ে উঠে খোদার প্রেমে আসক্ত হইবার’।

খোদার আসক্তি, খোদার প্রতি প্রেম ও ভক্তি এটা বরং শান্তির ব্যাধি, এর কামনায় জীবন অবসান ঘটলেও কোনো ক্ষতি নাই লাভ ছাড়া। শারীরিক ও মানসিক পীড়ায় পীড়িত হয়ে যে তা থেকে উত্তরণের জন্য দয়াময়ের দরবারে নিজেকে সমর্পণের মাধ্যমে তার প্রেমে আসক্তি লাভ করেছে, সে যেন পরম শান্তির ব্যাধিতে আসক্ত হলো। খোদার প্রতি প্রেম যেন এক দুরারোগ্য ব্যাধি। এ সারিবার কোনো সময়কাল নেই, কোনো কবিরাজ বা ডাক্তার তা সারাইতে পারে না। কোনো ওষুধ বা পথ্য এই ব্যাধি সারাইবার অযোগ্য।

তাই এ বৃথা চেষ্টা না করাই মঙ্গল। তাই এ ব্যাধিতে আসক্ত হইবার কথা এবং তাহাকে পুঁজি করিয়া হাসরের ময়দানে বিচারকালে দণ্ডায়মান হইবার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি হইতে উপসমের পর ইহকালের প্রশান্তি আছে যার প্রয়োজন অনেক, তবে খোদার প্রেমে আসক্তি ব্যাধি হইতে উপশম না হওয়াটাই শ্রেয়। তাতে ইহকাল এবং পরকলের প্রশান্তি মিলিবে। যার প্রয়োজনীয়তা আপরিসীম। শারীরিক এবং মানসিক ব্যাধি হতে উপসমের যেমন প্রয়োজন, তেমনি আত্মিক প্রশান্তির জন্য খোদার প্রেমে আসক্ত হবার ব্যাধিরও প্রয়োজন আছে। দয়াময় যা দিয়েছেন তা নিয়ে নত শীরে স্রষ্টার ইচ্ছা পূরণ করে প্রফুল্ল হৃদয়ে আগ্রহ সহকার খোদার আদেশ পালন করার সামর্থ অর্জন করার মাধ্যমেই খোদার প্রতি ভক্তি নিহিত আছে। নিজের কোনো কিছু ফুটাইয়া তোলা, নিজেকে বড় মনে করিয়া দেখা এ যেন জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ। তাহা হইতে দূরে থাকাই মঙ্গল। তাই অনেক বেশি প্রত্যাশার মধ্যে না যাওয়া, যাহা আছে বা যাহা পেয়েছি তাকেই মাথা পেতে নেওয়া নিঃশব্দে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছণীয়। অন্যদের কোনো কিছুর প্রতি লোভ না করে শান্ত থাকার মধ্যেই খোদার প্রেম পাওয়া যায়। এতেই সুখ রয়েছে। এই প্রেমের আসক্তি বা ব্যাধি আমাদের পরকালের পুঁজি হিসেবে খোদার আরশে লিপিবদ্ধ থাকিবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত