ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হোক শিক্ষা

রায়হান আহমেদ তপাদার
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হোক শিক্ষা

যেকোনো দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের মৌলিক উদ্দেশ্যই থাকে মূলত ব্যক্তির মানবিক গুণাবলির সুস্থ বিকাশ, যার মধ্য দিয়ে সে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এবারের শিক্ষাক্রম উন্নয়নে সর্বজনবিদিত দার্শনিক, ঐতিহাসিক, মনোবিজ্ঞান, বাস্তবসম্মতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রতি অগ্রাধিকারের কথা বলা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কারিকুলাম প্রণয়নে এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব অনেক আগে থেকে দিয়ে এসেছে। তবে দেরি করে হলেও এবার শিক্ষাক্রমে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি মৌলিক কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবারই জাতীয় শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কমিটি সায়েন্টিফিক আর্টিকেলগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো আলোচনা করেছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তবে ভাষান্তর করতে গিয়ে অনেক বিষয় দুর্বোধ্য করে তুলেছে, যা অনেকের কাছেই শিক্ষাক্রমের যে মৌলিক গ্রহণযোগ্যতা, তা সফল করতে পারবে কিনা, সন্দেহ আছে। নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার অভিলক্ষ্যে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে, গভীর শিখনের বিষয়ে গুরুত্বে মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের অগ্রাধিকার প্রদান করা। এ ছাড়া খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন ক্লাসের পাঠ ক্লাসেই শেষ করতে পারে, যাতে করে বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক ফেলানো সম্ভব হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতায় প্রাপ্ত সনদে জীবন-জীবিকার সুযোগ পায়। পরীক্ষাভীতি দূর করার জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে ট্র্যাডিশনাল কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে বলাই যেতে পারে, পরীক্ষা বিহীন শিক্ষা অর্জনের পথে হাঁটছে এবারের জাতীয় শিক্ষাক্রম। অনেকটাই কারিগরি স্টাইলে চলবে পড়াশোনা। ফলে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করে নিজেকে আগামী দিনের জীবন যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুলে মূল্যায়নের জন্য মূলত দুটি ধাপকে বেছে নেওয়া হয়েছে। একটি হলো শিখনকালীন মূল্যায়ন আর অন্যটি হলো সামষ্টিক মূল্যায়ন। শিখনকালীন মূল্যায়নে পর্যবেক্ষণ, প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন, মূল্যায়নে টেকনোলজির (অ্যাপস) ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। তবে ঠিক কীভাবে এই মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি হবে, তা জানা সম্ভব হয়নি, তেমনি সামষ্টিক মূল্যায়ন বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রূপরেখায় দেওয়া হয়নি। রূপরেখায় বলা হচ্ছে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে শুধু শিখনকালীন মূল্যায়নে আর চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়নের পাশাপাশি উচ্চ ক্রমানুসারে সামষ্টিক মূল্যায়নে জোর দেওয়া হয়েছে। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়ার) স্ফুটনিক-১ উপগ্রহ পাঠানোর পর পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিল।

রাশিয়ার থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা দেখল, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটালে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়বে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র কম্পিটেন্সি বেইজড এডুকেশন ধারণা তৈরি করেছিল। এরপর অনেক সময় কেটে গেছে। কম সময়ে দক্ষ জনশক্তি গড়তে ২০১৩ সালে আফ্রিকার দেশ হিসেবে কম্পিটেন্স বেইজড এডুকেশন বা সিবিই চালু করে জাম্বিয়া। আফ্রিকারই আর একটি দেশ রুয়ান্ডা ২০১৫ সাল থেকে সেই দেশে পারদর্শিতাভিত্তিক পড়াশোনা চালু করেছে। ক্লাসের মূল্যায়ন ছাড়াও এই দেশ বার্ষিক, জেলাভিত্তিক ও পাবলিক পরীক্ষা সচল রেখেছে। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে বড় ধরনের প্রভাব রেখেছে আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। ২০১৭ সাল থেকে চালু হওয়া সেই দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমের কাঠামোর অনেকাংশ আমাদের শিক্ষাক্রমে ঢুকে পড়েছে। ইউনেস্কোর সহযোগিতায় হওয়া এই কারিকুলামে পারদর্শিতানির্ভর মূল্যায়নে গ্রেডিং পদ্ধতিও সচল রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার লক্ষ্যে তানজেনিয়া ২০১৯ সাল থেকে সেই দেশে জাতীয় শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আনে। জাম্বিয়া, কেনিয়ার মতো তারাও এক ধারার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছে। তবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে কম্পিটেন্সি বেইজড ছাড়াও স্কুলের বাইরে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। চতুর্থ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা রেখেছে দেশটি। আমাদের দেশে আগে যেমন পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ছিল, সেখানে তারা নির্ধারিত শ্রেণির পড়াশোনা শেষে পরীক্ষা নিচ্ছে। বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ে লিখিত, মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ দিয়েছে তারা। সেই সঙ্গে থাকছে গ্রেডিং সিস্টেম। যোগ্যতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা কোথায়? কেনিয়া, জাম্বিয়া কিংবা তানজেনিয়ায় যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, তা নিয়ে সেই দেশগুলোতে সমালোচনা, বিক্ষোভ হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে শিক্ষার এই পরিবর্তন তারা করলেও শিক্ষা উপকরণ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সিবিএই শিক্ষা কাঠামোকে শক্তিশালী করছে। এরপরও এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে রয়েছে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ। প্রজেক্টনির্ভর কিংবা হাতের কাজ দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের প্রসারণ প্রয়োজন। ধরা যাক, একটি কক্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থীর আসন রয়েছে, এখন এই শিক্ষার্থীদের দলগতভাবে কাজ দিলে কিংবা বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দিলে, তারা শ্রেণিকক্ষে যে আসনে ক্লাস করত, তার চেয়ে বড় জায়গার প্রয়োজন। কম্পিটেন্সি বেইজড শিক্ষার জন্য শ্রেণিকক্ষের আধুনিকায়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেখানে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন কার্ড, কুইজ কিংবা ডিজিটালবিষয় উপস্থাপনের জন্য সাউন্ড সিস্টেম, মনিটার বা প্রোজেক্টর প্রয়োজন। কিন্তু সেগুলোর সরবরাহ করতে না পারলে এই শিক্ষা ধারা বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যোগ্যতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কোর পার্ট হলো ‘মূল্যায়ন ব্যবস্থা’। অ্যাসেসমেন্ট ধরন ব্যক্তিভেদেও ভিন্ন যেমন হবে, তেমনি প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্নতা থাকবে। যে ব্যক্তি মূল্যায়ন করছে, তার সঠিক প্রশিক্ষণ কিংবা উপকরণ না থাকলে সঠিক কাজ দেবে না। সুতরাং আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে দুর্বলতা কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। হয়তো রাজনৈতিক সংকটের সময় শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কথা বলার বা শোনার পরিবেশ হয়তো নেই। কিন্তু এই আলোচনা দরকার। আরেকটি শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে যাচ্ছে এবং সম্ভাব্য বড় ঝুঁকি এড়ানোর সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিভ্রান্তি ও উদ্বিগ্ন। কিছু অভিভাবক প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমেছেন। শিক্ষাবিদদের অনেকে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। ২০১২ সালে প্রবর্তিত শিক্ষাক্রমে যা আছে, তা বিদ্যালয়ে কাজে লাগানো যায়নি নানা কারণে। তাই বিদ্যালয়শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়বস্তুর বিন্যাস ও শিক্ষণ-শিখনের দিকনির্দেশনায় বড় পরিবর্তনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষাক্রম কেন কাজে লাগানো গেল না এবং সে জন্য কী শর্ত মেটাতে হতো, তা থেকে পাঠ গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ শিক্ষা-কাঠামো, ব্যবস্থাপনা এবং মান-নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে খুব বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে এমনটি জোর দিয়ে বলা যাবে না। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি ও অসঙ্গতি রয়ে গেছে। সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এখনো তৈরি হয়নি। আবার সব স্তরে এবং সব প্রতিষ্ঠানে যে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাও নয়। কোনো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেকার সৃষ্টির কারখানায় পরিণত হয়েছে; তারা সার্টিফিকেট বিতরণ করছে-জ্ঞানপ্রদানের দিকে তেমনভাবে নজর দিচ্ছে না। পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার অভাবে প্রতি বছর শিক্ষা শেষ করে অনেকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না। মানবসম্পদ-ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু পরিবেশ আজও নিশ্চিত হয়নি। বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি না হওয়ায় একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব, অন্যদিকে বাড়ছে দক্ষ-প্রশিক্ষিত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষিত লোকের অভাব। কাজেই এসব অসঙ্গতি দূর করে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পেশা ও কর্মমুখী পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দিকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে গত ৫২ বছরে শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কিছু সাফল্য এবং অর্জনের পরেও, হিসাবের খাতা খুললে দেখা যায়- আমরা অনেক অনেক চিন্তার জায়গায় পিছিয়ে আছি। যেভাবে সাধারণ শিক্ষা বিস্তার লাভ করেছে, সেই তুলনায় কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পথ বিস্তৃত হয়নি। সময়ের সঙ্গে, যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা শিক্ষাকে কাজে লাগাতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছি। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে শিক্ষাকে আমরা সম্পৃক্ত করতে পারিনি। বিশেষত, শিক্ষকদের সক্ষমতা কীভাবে বাড়াতে হবে, সে বিষয়টি বিবেচিত হয়নি। সেটা করলে এত উচ্চাভিলাষী পরিবর্তন এক ধাপে করার পরিকল্পনা নেওয়া হতো না। অথচ একুশ শতকের প্রয়োজন জানা নয়, করে দেখানো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক শিখন তত্ত্বে স্বীকৃত যে জ্ঞানের ভিত্তির ওপর প্রকৃত দক্ষতা তৈরি হয়। তা না হলে মুখস্থ বিদ্যা বা যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে। যা-ই হোক, জীবনের সব সাফল্যই কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে না। তবে তিন লাখ শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়ার কারণ কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এজন্য শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর দোষ চাপালেও হবে না। এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত