ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বায়ুদূষণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের পথে বড় অন্তরায়

জিল্লুর রহমান
বায়ুদূষণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের পথে বড় অন্তরায়

বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশকে বায়ু দূষণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ বার বার শীর্ষস্থান দখল করে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের অন্যতম দূষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে জনপ্রতি পাঁচ বছরেরও বেশি আয়ু কমতে পারে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও বায়ু দূষণে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে প্রায় ৭ বছর। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বায়ুর ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে স্বাস্থ্যের ওপর যে বিপজ্জনক প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (এপিক) তাদের সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি দূষণ দেখা গেছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে। এর আগে ২০২০ সালের মার্চে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইকিউএয়ারের বায়ু দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। সংস্থাটি ২০২০ সালের বিশ্বের বায়ুর মানের ওপর ভিত্তি করে ওই তালিকা প্রস্তুত করে এবং এর বৈশ্বিক বায়ুর গুণাগুণ প্রতিবেদন ২০২০ বলছে, বাংলাদেশের বায়ুর মান বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ, যেখানে ২০২০ সালে রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয় সর্বাধিক বায়ু দূষিত শহর এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বের দূষিত অঞ্চল বাংলাদেশ প্রথম, ভারত দ্বিতীয় এবং পাকিস্তান তৃতীয়। এছাড়া বিশ্বের ৫০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ৪২টি এ অঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে সবচেয়ে খারাপ দূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এবং এই ফলাফল অনুসারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতির মোটেও উন্নতি হয়নি, এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক চিত্র। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন ২০২০ সালে উল্লেখ করেছিল, বায়ুর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল। বাংলাদেশে পরিস্থিতি বিশেষ করে ভয়াবহ, বায়ু দূষণের কারণে তখন এক দশমিক ৭৩ লাখ মৃত্যু হয়েছে এবং সমগ্র জনসংখ্যা এমন এলাকায় বসবাস করছে, যেখানে বায়ুর গুণমান একেবারেই নিরাপদ বলে ধরা হয় না। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণ বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের পরে দ্বিতীয় প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের আয়ু আরো প্রায় এক দশমিক তিন বছরের সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত লাভ দেখতে পেত যদি বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলত। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার আধিপত্যের একটি বড় কারণ হল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্যিক ও নির্মাণ কার্যক্রমের বৃদ্ধি। শহরের বায়ু দূষণের দুটি প্রধান উৎস শিল্প বর্জ্য এবং যানবাহনের নির্গমন। ঢাকার আশপাশে প্রায় ২ হাজার ২৯৫টি ইটের ভাটা রয়েছে, যা বাতাসে সূক্ষ্ম কণা নির্গত করে। বায়ু দূষণের জন্য চলমান বিভিন্ন প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় যা শহরের বেশিরভাগ উল্লেখযোগ্য অংশে যানজটের সৃষ্টি করেছে। তা ছাড়া, ধূমপান, এয়ার কন্ডিশনার থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ান, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে খোলাখুলিভাবে পোড়ান, পৌরসভা ও কৃষিবর্জ্য পোড়ান, নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত করে যা মহানগরের বায়ুর গুণমানকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ করে যা একটি নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে এবং গুরুতরভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়। উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণের সংস্পর্শে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল স্বাস্থ্যের ফলাফল হতে পারে। এটি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, হৃদরোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। বায়ু দূষণকারী স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি গুণাগুণ উভয়ই স্বাস্থ্যের ঝুঁকির সঙ্গে জড়িত। আরো গুরুতর প্রভাবে এগুলো সুস্থ ব্যক্তিদের অসুস্থ করে তোলে এবং এক্ষেত্রে শিশু, বয়স্ক এবং দরিদ্র মানুষ বেশি সংবেদনশীল। বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, অত্যধিক অকালমৃত্যুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং সূক্ষ্ম ২.৫-পিএম কণা যা ফুসফুসের পথের গভীরে প্রবেশ করে। ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজধানীর বায়ুদূষণ কমাতে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। আদালত রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণ চিহ্নিত করে একটি নির্দেশিকা প্রণয়নের জন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সপ্তাহে দুবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিল। ঢাকায় বায়ুদূষণের ওপর বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের এক নম্বর কারণ হল ইটভাটা এবং নরওয়ের একজন বিশেষজ্ঞও একটি গবেষণায় উল্লেখ করেছেন রাজধানী শহরের বায়ুদূষণের ৫২ শতাংশ কারণ ইটভাটা। ইটভাটা আসলে, পরিবেশ সম্পর্কিত আইন এবং এর যথাযথ সচেতনতা সম্পর্কে আমাদের গুরুতর উদাসীনতা রয়েছে। শহর বা শহরের রাস্তা পরিষ্কার এবং নদীকে দূষণমুক্ত করতেও আমাদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। অবশ্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, পরিবেশ অধিদপ্তর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া ও নবায়ন দুর্নীতির বড় ক্ষেত্র। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে ৬৬ শতাংশ শিল্পকারখানাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। শ্রেণিভেদে এ অর্থের পরিমাণ ৩৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপনের আইনি বিধান না থাকলেও ৭২ শতাংশ কারখানার অবস্থান আবাসিক এলাকায়। গবেষণায় আরো দেখা যায়, কমলা-খ ও লাল শ্রেণিভুক্ত কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্রের সময় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ইএমপি) জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৫৭ শতাংশ কারখানা ইএমপি ছাড়াই পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেতে সব কারখানাকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দিতে হয়। কিন্তু ১৭ শতাংশ কারখানা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এনওসি ছাড়াই ছাড়পত্র পেয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন ও তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতিতে পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত