ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মুসলিম বাঙালি বীরের প্রতীক ছিলেন ঈশা খাঁ

মাহমুদ সালেহীন খান
মুসলিম বাঙালি বীরের প্রতীক ছিলেন ঈশা খাঁ

১৬ শতকে বাংলার পূর্বাঞ্চলের বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম নেতা এবং মুসলিম বাঙালি বীরের প্রতীক ছিলেন ঈশা খাঁ। বাংলার ইতিহাসে ‘বারো ভূঁইয়া’ আমল একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ, এই বারো ভূঁইয়ারা ছিলেন স্বাধীনচেতা বীরযোদ্ধা। তারা দিল্লির সম্রাটদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতেন। ১৩ শতকের শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইসলামী শাসনের সূচনা হয় যা ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই সময়কালে প্রথমে দিল্লির সুলতানরা ও পরে মুঘল বাদশাহরা বাংলাকে দিল্লির শাসনাধীনে রাখার জন্য অব্যাহত চেষ্টা করে গেছেন। ফলে বাংলা কখনো দিল্লির অধীন ছিল, আবার কখনো কখনো স্বাধীন ছিল। স্বাধীন সুলতানী আমলের মতো বারো ভূঁইয়াদের আমলও বাংলার ইতিহাসে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজত্বকাল হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বারো ভূঁইয়ারা হলেন- ১. ঈশা খাঁ- খিজিরপুর বা কর্ত্তাভূ ২. প্রতাপাদিত্য- যশোর ৩. চাঁদ রায় ও কেদার রায়- শ্রীপুর বা বিক্রমপুর ৪. কন্দর্প রায় ও রামচন্দ্র- বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপ ৫. লক্ষ্মণমাণিক্য- ভূলুয়া; ৬. মুকুন্দ রায়- ভূষণা বা ফতেহাবাদ ৭. ফজল গাজী ও চাঁদ গাজী- ভাওয়াল ও চাঁদপ্রতাপ; ৮. হামীর মল্ল বা বীর হাম্বীর- বিষ্ণুপুর; ৯. কংসনারায়ণ- তাহিরপুর; ১০. রামকৃষ্ণ- সাতৈল; ১১. পীতাম্বর ও নীলাম্বর- পুটিয়া; ১২. ঈশা খাঁ লোহানী ও ওসমান খাঁ- উড়িষ্যা ও হিজলী। বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ঈশা খাঁ। যিনি স্বাধীন সম্রাটের মতো ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধি নিয়েছিলেন। ঈশা খাঁর সময় আরো যারা শৌর্যে-বীর্যে বলীয়ান ছিলেন তারা হলেন- যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য, চন্দ্রদ্বীপের কন্দর্পনারায়ণ, বিক্রমপুরের চাঁদ রায় ও কেদার রায় এবং ভাওয়ালের ফজল গাজী ও চাঁদ গাজী।

ঐতিহাসিকদের মতে, ঈশা খাঁ নিজেও হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া পিতার সন্তান ছিলেন। অযোধ্যার বাইশওয়ার পরগনায় এক ক্ষত্রিয় রাজার বংশধর তিনি। এই রাজার নাম ছিল ভগীরথ। ভগীরথের সাথে দিল্লির বাদশাহ ফিরোজ শাহ তুঘলকের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। রাজা ভগীরথ একবার তীর্থ দর্শনে বাংলায় আসেন। তখন বাংলার শাসক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। এ সময় গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় তিনি বাংলাতেই থেকে যান। জনশ্রুতি রয়েছে, এই রাজা ভগীরথের বংশেই জন্মগ্রহণ করেন একজন পণ্ডিত। তাঁর নাম ছিল কালীদাস। পণ্ডিত কালীদাস নিজ হাতে নানা জিনিস তৈরি করতে পারতেন, তার মধ্যে একটি ছিল স্বর্ণহাতি। তিনি প্রায়ই সোনার হাতি গড়তেন। এ জন্যই নাকি কালীদাসের ভক্তরা তাকে উপাধি দিয়েছিল গজদানি। সেই থেকে কালীদাস গজদানি নামে পরিচিত হন।

এই কালীদাস গজদানি দেখতে অপরূপ সুন্দর ছিলেন। তার পৌরুষদীপ্ত রাজকীয় চেহারা দেখে মুগ্ধ হন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের কন্যা। মাহমুদ শাহের কন্যা কালীদাস গজদানীকে পতি হিসেবে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কালীদাসকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য তিনি যে চিঠি দিয়েছিলেন, তার উত্তরে কালীদাস প্রচুর সদবাক্য ও বহু সদুপদেশ দান করেন এবং বিনয়ের সাথে রাজকন্যার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করেন।

কিন্তু রাজকন্যা দমবার পাত্রী ছিলেন না। তিনি নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত কালীদাসের সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হন, তিনি রাজকন্যাকে বিয়ে করতে সম্মত হন। কথিত আছে, কালীদাস গজদানী উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, ধর্মের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। বিভিন্ন ধর্মের সার কথা জানার জন্য তিনি ধর্মীয় বিতর্কের ব্যবস্থা করতেন। নিজেও তর্কে অংশগ্রহণ করতেন।

এভাবে আলোচনা করতে গিয়েই জনৈক মুসলিম মনীষীর কথা শুনে তিনি এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর কালিদাসের নতুন নাম হয় সুলাইমান খাঁ। এই সুলাইমান খাঁরই পুত্র ছিলেন ঈশা খাঁ। বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের শেষ শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর তার জামাতা সুলাইমান খাঁ নিজেকে সালতানাতের উত্তরাধিকারী দাবি করে পূর্ব বাংলায় রাজত্ব করতে শুরু করেন। দিল্লিতে নব প্রতিষ্ঠিত আফগান শাসনের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি প্রায় স্বাধীনভাবেই ভাটি অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন এবং তাঁর রাজ্য শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সরাইল। বাংলার উত্তর-পশ্চিমাংশ তখন আফগান সম্রাটদের দখলে।

১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে আফগান সম্রাট শেরশাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করে বাংলাকে একটি একক প্রশাসনিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু সুলাইমান খাঁ ইসলাম শাহের ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করলে ইসলাম শাহ তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দু’জন সেনাপতিকে তার বিরুদ্ধে পাঠান। সুলায়মান খান তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত ও নিহত হন এবং তার দুই পুত্র ঈসা ও ইসমাইলকে বন্দি করে ইরানী বণিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ১৫৬৩ সালে তাজ খান কররানী বাংলা ও বিহারের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করলে, ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ তার অনুগ্রভাজন হন এবং দরবারি কাজে নিযুক্তি লাভ করেন। এ সময়ে তিনি তাঁর দুই ভাতিজা ঈসা ও ইসমাইলের খোঁজ পেয়ে অর্থের বিনিময়ে ইরানী বণিকের কাছ থেকে তাদের মুক্ত করে আনেন। ঈসা খাঁ দেশে ফিরে এসে চাচা কুতুব খানের চেষ্টায় আফগানদের কাছ থেকে তার পিতার সরাইলস্থ জমিদারি উদ্ধার করেন। ১৫৬৫ সালে তাজ খান কররানীর মৃত্যুর পর ঈসা খাঁ আফগান শাসকদের মোঘল আক্রমণ মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের কাছে আগমহলের যুদ্ধে মোঘলদের কাছে দাউদ খান কররানী পরাজিত ও নিহত হলে কার্যত বাংলায় আফগান শাসনের অবসান ঘটে। ঈসা খাঁ এ সময়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই তাঁর রাজ্য পরিচালনা করছিলেন।

কিন্তু তিনি যথার্থভাবেই বুঝতে পারেন যে, তিনি নিজের সীমিত শক্তি দিয়ে একা মোঘলদের মোকাবিলা করতে পারবেন না। তাই তিনি বাংলার পূর্বাঞ্চলের সব জমিদার ও আফগান দলপতিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের সঙ্গে মোঘলবিরোধী রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠন করেন। প্রতিবেশী ত্রিপুরা ও কামরূপের রাজা যথাক্রমে অমরমাণিক্য ও রঘুদেবের সঙ্গেও বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এ ছাড়াও ঈসা খান একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। শৌর্য-বীর্যে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি মশহুর হয়ে উঠেন পুরো বাংলায়। বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং সম্ভবত বৃহত্তর রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু অংশ সহ বিশাল রাজত্ব ছিলো ঈশা খাঁর। ক্রমে ঈশা খাঁ বাংলায় এতোটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে, স্বাধীন সম্রাটের মতোই তিনি জীবন-যাপন করতেন ও রাজ্য শাসন করতেন। ঈশা খাঁর বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্যের সংবাদ চলে যায় দিল্লীর মুঘল সম্রাটের কাছে। দিল্লীর সম্রাট শঙ্কিত হয়ে পড়েন। বাংলার সুবাদার করে পাঠান শাহবাজ খাঁকে। মুঘল সুবাদার শাহবাজ খাঁকে জঙ্গলবাড়ির যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন বীর ঈশা খাঁ। এরপর ১৫৯৭ সালে সেনাপতি মানসিংহ বিশাল মোঘল বাহিনী নিয়ে ধেয়ে আসেন বাংলার বীর ঈশা খাঁকে দমন করতে। মোঘল সেনাপতি মানসিংহের আগমনে বঙ্গবীর ঈশা খাঁ মোটেই ভীত হলেন না। মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে তিনি আস্তানা গাড়েন এগারোসিন্ধুর দুর্গে। রাজা মানসিংহ নদীর তীর বেয়ে হাজির হন এগারোসিন্ধুর দুর্গের কাছে। যুদ্ধ চলল তুমুল গতিতে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রাজা মানসিংহের জামাতা দুর্জয় সিংহ নিহত হলো। প্রতিশোধের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠলেন রাজা মানসিংহ। সরাসরি দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের আহ্বান জানালেন ঈশা খাঁকে। দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে ঈশা খাঁর তরবারীর আঘাতে রাজা মানসিংহের তরবারি দ্বিখন্ডিত হলো। নিরস্ত্র হয়ে হতবাক হয়ে গেলেন রাজা মানসিংহ। দুর্ধর্ষ বীর ঈশা খাঁ এক আঘাতেই পারতেন রাজপুত বীর মানসিংহের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে দিতে। কিন্তু তিনি তা করলেন না। তরবারি নামিয়ে শত্রুর কাছে গিয়ে বললেন, নিরস্ত্রকে হত্যা করা ইসলাম ধর্মের রীতি নয়। এই নিন তরবারি। শক্তি পরীক্ষা করুন শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে জয় পরাজয়। বেকায়দায় পেয়ে কাউকে হত্যা কিংবা পরাজয়ে বাধ্য করা বীরধর্ম নয়। ঈশা খাঁর কথা শুনে মানসিংহ অবাক। সারা জীবন যুদ্ধের মধ্যে কাটিয়েছেন। এমন কথা শুনেননি কখনো। এমন হৃদয়বান বীর জীবনে দেখেননি। ‘এমন বীরের সাথে আর যুদ্ধ নয়। আমি আপনার শৌর্য-বীর্যে মুগ্ধ, অভিভূত। আমি পরাজয় স্বীকার করলাম। সত্যিই আপনি অদ্বিতীয় বীর।’ এরকম মন্তব্য ছিল মানসিংহের। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলায় মাথা উঁচু করেই রাজ্য শাসন করেন ঈশা খাঁ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত