ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন

মিজানুর রহমান মিজান
শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন

ঋতু পরিক্রমায় ধীরে ধীরে শীতের আগমন ঘটছে। এই শীত নিয়ে আসে কিছু মানুষের জন্য শান্তিময় আগমনী বার্তা। তাদের মধ্যে দেখা যায় শীতের নানা প্রকার কাপড় পরার আমেজ। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। তারা মূলত শীতকে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু নিম্নবিত্ত এবং সামাজে পিছিয়েপড়া মানুষের জন্য এই শীত নিয়ে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভোগ। তারা প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় না থাকার করণে শীতে প্রচণ্ড রকমের কষ্ট করে। বিশেষ করে গৃহহীন মানুষ, পথশিশুদের কষ্টের কোনো শেষ থাকে না এই শীতকালে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য চেষ্টা করা। তাহলে হয়তো এই শীতার্ত মানুষগুলোর কষ্ট কিছুটা কমে আসবে। বর্তমানে বাংলাদেশে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। আমাদের আশপাশেও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। সড়কের পাশে, বাস ও ট্রেন স্টেশনে, বাজার-ঘাটে রাতের বেলা এমন অনেক অসহায় মানুষকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আমরা যখন লেপ-কম্বল গায়ে জড়িয়ে দীর্ঘ রাত সুখ নিদ্রায় বিভোর তখন তাদের রাত কাটে নির্ঘুম অবস্থায় শীতের প্রকোপে যবুথবু হয়ে। যার পেটে ভাত নেই তার গায়ে গরম কাপড় জুটবে কোত্থেকে! আমরা কি পারি না তাদের সাহায্যে একটু এগিয়ে আসতে? সমাজের অসহায় ও শীতার্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসার মাধ্যমেই রচিত হবে মানবিক সেতুবন্ধন। আমাদের সামান্য সহযোগিতা তাদের জীবনে এনে দিতে পারে এক টুকরো সুখ। কনকনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপা মানুষের গায়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে তার মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ব ও ভালোবাসার। আমরা চাইলেই এসব দুঃখী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি। এজন্য কি অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়া প্রয়োজন? মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাও করতে পারেন অনেক কিছু। এসব অসহায়দের প্রতি তাদেরও রয়েছে কিছু নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের উপার্জিত অর্থের সামান্য পরিমাণও যদি এসব অসহায়দের জন্য আমরা বরাদ্দ করি তাহলে বিন্দু বিন্দু সে দান শীতার্তদের কষ্ট লাঘবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। ষড়ঋতুর এই দেশে এখন আর ষড়ঋতু নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীত, গরম ও বর্ষা- এই তিন ঋতুরই প্রভাব। প্রচণ্ড গরম, অতিমাত্রায় শীত ও অতিবৃষ্টির প্রভাব বেশি। ষড়ঋতুতে বাংলা পৌষ ও মাঘ শীতকাল হলেও কোনো কোনো বছর কার্তিকের শেষদিক থেকে শীত শুরু হয় এবং তা থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এর মাত্রা নিচে নেমে আসে। তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ শীত অনেক সময় হাড় কাঁপানো শীতে পরিণত হয়। এ বছর শীত অনেক আগে এসেছে। কার্তিক মাসের শেষদিকে ও অগ্রহায়ণ মাসের শুরুর দিকে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। সারা দেশে এখন হাড় কাঁপানো শীত। এই শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা তিন-চারগুণ বেশি। দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য শীতকাল বড় কষ্টের। শীতকাল এলেই দরিদ্র অসহায় মানুষ শীতে জবুথবু হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালের পর যেমন শীতকাল আসে তেমনিভাবে সুখের পর দুঃখ। আর সুখ-দুঃখকে নিয়েই আমাদের জীবনযাপন করতে হয়। একইভাবে শীতকাল এসেছে ধনীদের জন্য সুখ, আনন্দ ও উল্লাস নিয়ে এবং গরিবদের জন্য দুঃখ, হতাশা ও অশান্তি নিয়ে। একদিকে শীতকাল এলে বিত্তবান শ্রেণির মানুষগুলো খুশিতে আনন্দিত হয়। অন্যদিকে শীতকাল এলে গরিব, দুর্ভাগা, সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো দুঃখিত হয়। আমাদের সমাজে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য শীতকাল হলো এক ধরনের অভিশাপ। আমরা জানি, সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো গ্রীষ্মকালে বা গরমের দিনে ফুটপাথ, রেলস্টেশন ও বস্তিতে থাকতে পারে। কিন্তু শীতকালে তাদের জন্য ফুটপাথ কিংবা রেলস্টেশনে থাকা খুবই কষ্টকর বা অসহনীয়। তা ছাড়া শীতে তাদের মাঝেমধ্যে না খেয়েও থাকতে হয়। শৈত্যপ্রবাহের রুষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ন্যূনতম ব্যবস্থাপনাও তাদের থাকে না। ফলে অসহায় ও হতদরিদ্রদের কষ্ট কেবল বেড়েই যায়। বৃদ্ধ, শিশু ও ফুটপাথের গরিব মানুষ গরম কাপড়ের অভাবে মারাও যায়। গত কয়েক দিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে শীতের তীব্রতা অনেক বেড়েছে। বর্তমান শৈত্যপ্রবাহ আর ঠান্ডা দেশের উত্তরাঞ্চলের নিম্নআয়ের জনগণ অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছে, সেই সঙ্গে ডায়রিয়া, জ্বর, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। শীতের সময় করোনাভাইরাসের আরেক দফা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এজন্য নানা প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। তবে শীতকালে দেশের কোথাও শীত বেশি-কম হতেই পারে। এতে কারও হাত নেই, এটি প্রাকৃতিক। তবে এক্ষেত্রে শীতার্তদের জন্য আমাদের অনেক কিছুই করণীয় আছে। সরকারের পাশাপাশি আমরাও পারি শীতার্তদের জন্য আমাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে। শীতের সময় শহরাঞ্চলের মানুষের তুলনায় গ্রামের সাধারণ মানুষ বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। তারা যেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবার কিনতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে হয়, সেখানে শীতের বস্ত্র কেনা অসম্ভব একরকম। গ্রামের এসব মানুষের অনেকের পক্ষে আলাদাভাবে শীতের কাপড় কেনা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। প্রতিবছর শীতের সময় দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ে শীতার্ত মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। অতীতে সরকারি পর্যায়েও গরিব মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার সে ধরনের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে দেশে করোনার পরিস্থিতি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে মন্দাভাবের কারণে এক ধরনের জ্বরাগ্রস্ত সময় বিরাজ করছে। এর প্রভাব সামাজিক কর্মকাণ্ডের ওপরও পড়ছে। কিন্তু সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তা হলে মানুষের দুর্ভোগ শুধু বাড়বেই। এক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করা যায়। শীতের রাতে স্টেশন কিংবা শহরের অলিতে-গলিতে বের হলেই দেখা যায় শীতার্ত মানুষের কষ্টের করুণ চিত্র। শত শত মানুষ এই শীতে কষ্টে রাত্রি যাপন করছে। সেখানে বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই এই তীব্র শীতের কবলে ভুগছে। সামাজের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব এই কষ্টের সময়ে শীতার্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সামাজের সকল মানুষের সম্মেলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্ভব এই সমস্যা থেকে অসহায় মানুষগুলোকে উদ্ধার করা। তা ছাড়া সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমেও সম্ভব এ সমস্যার সমাধান। বিশেষ করে প্রতিটি অঞ্চলে জন প্রতিনিধিদের প্রয়োজন এই শীতে কষ্ট করা শীতার্ত মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা কর। তাদের নৈতিক দায়িত্ব শীতার্ত মানুষগুলো শীতের প্রয়োজনীয় বস্ত্র অনুদান দেওয়া। তাহলে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষগুলো কিছুটা হলেও এই শীতের কবল থেকে রক্ষা পাবে। প্রতি বছর শীত এলে অভাবীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা উচ্চারিত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ব্যতিক্রম যেটা হয়েছে, সেটা সাধারণভাবে চোখে পড়ার মতো নয়। ব্যতিক্রমটি হলো, প্রতি বছর সমাজের সামর্থ্যবান জনদরদি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্বল, শীতবস্ত্র, খাবার ইত্যাদি গ্রামে গ্রামে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। তরুণ যুবকরা মহল্লায় মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে এবং তা গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে। শীত এলে এসব ছিল চিরচেনা সামাজিক কর্মকাণ্ড। এবার সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এর অন্তর্নিহিত কারণটি হয়তো কোনো সমাজতাত্ত্বিক বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের সাধারণ বিচার-বিবেচনায় সামান্য সমাজ অধ্যয়নে যেটি মনে হয়, সেটি হলো- জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ এসব ধারণার সঙ্গে মানুষের একাত্মতার বোধ শিথিল হয়ে পড়েছে। তাই শীতে কষ্ট পাওয়া মানুষের কষ্ট লাঘবে আগের মতো সবার এগিয়ে না আসার পেছনে এটিই কারণ বলে আমাদের ধারণা। তবু বসে থাকলে চলবে না, দরিদ্র, অভাবী ও বস্ত্রহীন শীতার্ত মানুষকে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। সমাজে যারা বিত্তবান ব্যক্তি, তারা চাইলেই ছিন্নমূল মানুষের এই হাড় কাঁপানো শীতের সময় একটু সাহায্য করতে পারেন। আপনাদের একটু সহযোগিতার মাধ্যমেই সমাজে বসবাসরত গরিব অসহায় মানুষগুলোর মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারেন। ছিন্নমূল মানুষগুলো শুধু শীতের সময়ই কষ্ট পায় না, গরমের তাপদাহ ও বর্ষার অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জীবননাশের পরিক্রমায় পরিণত হয়ে পড়ে। দেশের নিম্নাঞ্চলের মানুষগুলো বর্ষাকালে আশ্রয়স্থল ও খাবার সঙ্কটে পড়ে যায়। যদি আমরা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি একটু মানবতা দেখাই এবং পাশে দাঁড়াই তা হলে আমরা তাদের অশান্তি একটু হলেও দূর করতে পারব, পাশাপাশি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হব। এই কনকনে শীতে ফুটপাথ, রেলস্টেশন ও বস্তিতে বসবাস করা মানুষগুলো শান্তিতে নেই। আমাদের সবার উচিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া। সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই এগিয়ে এলে শীতার্তরা উপকৃত হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত