উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলে রাত-দিন

আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় অভিনব আশির্বাদ

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান প্রেক্ষাপটে অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প নেই। যারা নিয়মিত মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন তারা এখন আর অন্য কোনো পাবলিক পরিবহনে ভ্রমণ করে স্বস্তি পাচ্ছেন না। রাজধানীর তীব্র যানজটে নিরুপায় হয়ে বসে থাকা দুঃসহ স্মৃতি যাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করছে তারাই এখন মেট্রোরেলে চড়ে বুঝতে পারছেন মেট্রোরেলে যাতায়াত এক অভিনব আর্শিবাদ। মেট্রোরেলের কারওয়ান বাজার ও শাহবাগ স্টেশন চালু হতে যাচ্ছে আগামীকাল। এর মাধ্যমে মেট্রোরেলের মতিঝিল পর্যন্ত সবগুলো স্টেশন চালু হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রেরেলে রাতের বেলাও চলাচল শুরু হতে পারে আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক এই তথ্য জানিয়েছেন। বর্তমানে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উত্তরা-মতিঝিল-উত্তরা রুটে মেট্রোরেল চলাচল করছে। আর উত্তরা-আগারগাঁও-উত্তরা রুটে চলাচল করছে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যানজটে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রতিদিন ১৭ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যানজটজনিত এক লাখ শ্রমঘণ্টার জন্য বছরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মিলিয়ে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঢাকা ও চট্টগ্রামে বছরে অন্তত ৪৯ হাজার কোটি টাকা যানজটে নষ্ট হচ্ছে! দুটি শহরের যানজটেই বছরে নষ্ট হচ্ছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ৭০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজেটের পৌনে ৮ শতাংশ। বর্তমানে ঢাকার গড় যানবাহন গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারের কম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার, বর্তমানে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। মেট্রোরেলের ভাড়া ঢাকার শ্রমজীবী মানুষ, রপ্তানিমুখী ও তৈরি পোশাকশিল্প শ্রমিক, ভাসমান শ্রমিক, নিম্ন এবং নিম্নমধ্যবিত্তের দৈনিক উপার্জনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। মেট্রোরেল শুধু মধ্যবিত্ত এবং অভিজাত লোকদের পরিবহন হিসেবে গড়ে উঠলে ঢাকার যানজট উল্লেখযোগ্য হারে কমবে না। গত ১২ ডিসেম্বর উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল পরীক্ষামূলক চলাচল করে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বাস ও মিনিবাসের চেয়ে সাত গুণ বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। মেট্রো চলাচলকারী রুটে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলকে কীভাবে সীমাবদ্ধ করা হবে, তা নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার হবে। বর্তমানে মোট জিডিপির ৩৭ শতাংশ জোগান দিচ্ছে ঢাকা। যানজট না থাকলে এটা আরও বাড়তে পারত। যানজটের কারণে একদিকে শ্রমঘণ্টা ও উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ঢাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। যানজটের কারণে দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে নগরায়ণের অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার রাজধানীতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বড় বাধা নিকৃষ্ট গণপরিবহন এবং অসহনীয় যানজট। একটি টেকসই মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে পরিচিতি পেতেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের যানজট বড় বাধা। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে যানজট সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনাগুলোর ধীর গতির বাস্তবায়নও সমস্যার তীব্রতা বাড়াচ্ছে। অসহনীয় ও তীব্র ক্ষতির যানজটের জন্য জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মাত্রাতিরিক্ত চাপ, ঢাকায় কেন্দ্রীভূত অদক্ষ প্রশাসন, কেন্দ্রীভূত সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বহুলাংশে দায়ী। ডিজিটাল যুগেও রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, তদবির-নিয়োগ-বদলি-পদায়ন, চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব কাজই ঢাকাকেন্দ্রিক। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে এখনো আমাদের ঢাকা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, কেউ বলছে না, চট্টগ্রাম সিলেট রাজশাহী খুলনা কিংবা বরিশালের মতো বিভাগে মেট্রো, বিআরটি বা ট্রামকেন্দ্রিক আধুনিক গণপরিবহন পরিকল্পনা কবে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে যেহেতু উত্তারা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে এবং রাতের বেলাও এই রুটে মেট্রোরেল চলবে তাই মানুষ দিন দিন আশ্বস্ত হচ্ছে যানজটের শহর ঢাকা একদিন যানমুক্ত হবে। মানুষ আরাম-আয়াশে অতি অল্প সময়ে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগর ও সংলগ্ন অঞ্চলে মোট ছয়টি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে এমআরটি-৬ এর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এখন মেট্রোরেল চলাচল করছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে উত্তরা থেকে সরাসরি পৌঁছানো যাবে কমলাপুর। এই প্রকল্পের বাইরে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও চলছে। এ জন্য ২০১৩ সালের ৩ জুন গঠিত হয় ঢাকা মাস ট্রানজিট (এমআরটি) কোম্পানি লিমিটেড। বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ, যানজট কমাবে মেট্রোরেল’ স্লোগানে যাত্রা করা এই কোম্পানি এরইমধ্যে এমআরটি লাইন-১ (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) এবং এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের (হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা) কাজও অনেকটা গুছিয়ে এনেছে। এমআরটি লাইন-৫ এর সাউদার্ন রুটও রয়েছে। এছাড়া এমআরটি-২ এবং এমআরটি-৪ রয়েছে পরিকল্পনার পর্যায়ে।