ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্ভুল জ্ঞান ও পথের সন্ধানে হোক বই উৎসব

রায়হান আহমেদ তপাদার
নির্ভুল জ্ঞান ও পথের সন্ধানে হোক বই উৎসব

শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। একটি জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। আর এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই বর্তমান সরকার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে সারাবিশ্বে। বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে নতুন বই। এ সময়ে সারাদেশে সাড়ম্বরে বই উৎসব পালিত হচ্ছে। নতুন বই শিক্ষার্থীদের জন্য এক অভিনব উপহার। বই সুন্দর ও শুভ চিন্তাভাবনার কথা বলে। মনের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। মনকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে। আমাদের মনে শুভ ভাবনার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। সেই আলোয় আমরা ভালো-মন্দ বিচার করতে পারি। স্বার্থপরতা ও মন্দ চিন্তাকে দূর করে ভালো মানুষ হয়ে উঠি। প্রকৃত অর্থে বই যে কোনো দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বই মানুষের মনের সকল কপাট খুলে দেয়, দৃষ্টিকে করে প্রসারিত ও সুদূরগামী। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন করে বই। স্রষ্টা, সৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায় বইয়ের মাধ্যমে। তাই সমাজ বিনির্মাণে, মানব সম্পদ উন্নয়নে, মেধা ও মনন বিকাশে তথা জাতি গঠনে বইয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবন ও বই পরস্পর নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। মানবজীবনের বড় আকুতি হলো জ্ঞানচর্চা।

বই পাঠের মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানলাভ ও মানসিক উন্নতি। বই সত্য, সুন্দর ও আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠক চিত্তকে ভরিয়ে তোলে। বই হতাশাগ্রস্ত কিংবা বিভ্রান্ত মানুষকে জীবনের মহৎ প্রাঙ্গণে পৌঁছে দিতে পারে। বই আমাদের আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায় এবং জীবনের সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়। বই মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করে। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েই মানুষ গড়ে তুলতে পারে উন্নত ও আনন্দ পূর্ণ আদর্শ জীবন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে মানব জীবন ও বইয়ের সর্ম্পক ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। সুশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই স্বশিক্ষিত। যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে মনের প্রসারতা দরকার, যা বই পাঠের অভ্যাসের মাধ্যমেই শুধু সম্ভব। উৎকৃষ্ট বই মানুষকে অকৃত্রিম আনন্দ ও প্রকৃত সুখ দান করে। মানুষের উন্নতর বৃত্তিগুলো চায় সত্য, জ্ঞান ও আনন্দের আলো।

কিন্তু আনন্দালোকে পৌঁছানো তথা পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের জন্য বই নির্বাচনে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আর এই বই পড়ার আনন্দ পরিপূর্ণভাবে লাভ করতে হলে অগণিত বই থেকে পাঠকে ভালো মানের বই নির্বাচন করে নিতে হয়। এব্যাপারে বইয়ের পাঠককে যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতন হতে হয়। আগ্রহপূর্ণ দৃষ্টি, অনুচিন্তন, কৌতূহল, পরিমিত পাঠ সবকিছু মিলে গ্রন্থপাঠ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ছাপাখানার কল্যাণে প্রতিনিয়ত অজস্র বই ছাপা ও প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে ভালো-মন্দের সমাবেশ আছে। পাঠের আনন্দ পেতে হলে ভালো মানের বই বাছাই করতে হবে, না হলে প-শ্রম হবে। বই নির্বাচনের অস্থির অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য অভিজ্ঞ পাঠক, গ্রন্থগারিক ও শিক্ষকদের সুপরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। বিজ্ঞাপনের চাতুরিপনা কিংবা গ্রন্থনামে প্রলুদ্ধ হওয়া উচিত নয়। ভালো বই মানুষকে আনন্দ দান করে, সেজন্য ভালো বই নির্বাচন করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ভালো মানের বই পড়ার পর জীবনের মোড় পাল্টে দেয়- একথা নতুন নয়। সেই পুরোনো কথাটি নতুন করে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেছেন মার্কিন গবেষকরা। তাদের ভাষায় মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশে পরিমাপযোগ্য পরিবর্তন আনে ভালো একটি বই। অতীতে আমরা দেখেছি, বই বিপণন নিয়ে নানা ঘটনা। বিনামূল্যে বিতরণের বই কালোবাজারে বিক্রি, বইয়ের সঙ্গে নোট বই কিনতে অভিভাবকদের বাধ্য করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণির বই বছরের পর বছর সময় মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রকাশকরা। অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকের মান নিয়েও সংশয় ছিল। অস্পষ্ট ছাপা, নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হতো এসব পাঠ্যপুস্তকে। কিন্তু বর্তমানে যে ঝকঝকে ছাপা রঙিন বইগুলো শিক্ষার্থীর হাতে দেয়া হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীদের বই পাঠের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে। সদিচ্ছা থাকলে এসব অন্তরায় দূর করা যায়, সেটা প্রমাণ করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী এর আগে একাধিকবার শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেছেন। এটি যে দারিদ্র্যমুক্তির কার্যকর অস্ত্র তা প্রমাণিত হয়েছে শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দারিদ্যমুক্তির ঘটনায়। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ শিক্ষা খাতে বাজেটের এক উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ যে জাতির জন্য সত্যিকার অর্থেই লাভজনক তা বাস্তবতার নিরিখেই প্রমাণিত হয়েছে। সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিনামূল্যে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিতরণ ও নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে তা বিশ্ব সমাজেরও প্রশংসা অর্জন করেছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বিনামূল্যের বই এখনো বাজারে পাওয়া যায়। ফলে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, দেশে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও বিতরণকে ঘিরে যে কায়েমি চক্র গড়ে উঠেছিল তারা এখনো সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের অনমনীয় মনোভাবই প্রত্যাশিত। পাশাপাশি মনে রাখা দরকার, বই উৎসবকে তাৎপর্যবহ করতে হলে শিক্ষার মানের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা মনে করি, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত, যাতে পাঠের ভেতর দিয়ে তারা আনন্দ খুঁজে পায়। পাঠ্যপুস্তক উৎসব তখনই অর্থবহ হবে যখন মানসম্মত শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি ঘরে। শিক্ষা হতে হবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। শিক্ষার মান নিশ্চিত সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও সে চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গেই মোকাবিলা করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে পারিবারিক শিক্ষার ওপরও, যাতে একজন শিক্ষার্থী নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন হিসেবে গড়ে ওঠে। অপরদিকে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। এই ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ২৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নম্বর অভীষ্ট হলো মানসম্মত শিক্ষা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসাভিত্তিক ইবতেদায়ি ও কওমি শিক্ষাব্যবস্থা এবং এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারি ও প্রি-ক্যাডেট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। প্রণিধানযোগ্য যে, টেকসই উন্নয়নের জন্য গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার শুরুটা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই।

১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভসূচনা করেছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে জাতীয়করণ করেন। এ ছাড়া কয়েকশ’ ইবতেদায়ি মাদ্রাসাকে এমপিওর আওতায় আনয়ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ প্রশংসিত এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই কিন্ত শিক্ষার মানের ওপর আরো নজরদারি বাড়ানোর দাবি সর্ব মহলের। পাঠ্যপুস্তক উৎসব তখনই অর্থবহ হবে যখন মানসম্মত শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি ঘরে। শিক্ষা হতে হবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও সে চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গেই মোকাবিলা করতে হবে। নতুন বছরে বই উৎসবে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত, শুধু নতুন বই বিতরণ নয়, প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা, যাতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে। আরো প্রয়োজন একক শিক্ষানীতি, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেবে, বিভিন্ন শিক্ষা নীতি চালু করে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি না করে একক শিক্ষানীতি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমাদের প্রজন্ম ভূমিকা রাখবে- এটাই সবার প্রত্যশা।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত