মানব পাচারের কবলে নিরাপদ অভিবাসন

দুর্বল বিচার প্রক্রিয়ায় রেহাই পেয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে প্রথমবারের মতো গতকাল পালিত হলো জাতীয় প্রবাসী দিবস। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ‘প্রবাসীর কল্যাণ, মর্যাদা-আমাদের অঙ্গীকার, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় তারাও সমান অংশীদার’ এই প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালন করে। দিবসটি উপলক্ষ্যে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো নিরাপদ, নিয়মিত ও বৈধ অভিবাসন নিশ্চিত করতে জেলায় জেলায় জব ফেয়ার আয়োজন করে। এছাড়া বিদেশে বাংলাদেশি মিশনসমূহ জাতীয় প্রবাসী দিবস উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কর্ম সংস্থানের অভাবে অনেক শিক্ষিত- কম শিক্ষিত কিংবা অর্ধ শিক্ষিত নারী-পুরুষ বিদেশের পথে পা বাড়ায়। তারা সেখানে কি কাজ করে দেশে অর্থ পাঠায় সেই প্রশ্ন না করাই শ্রেয়। তারা যে কোনো কাজ করুক না কেন সেটা যতটা সমস্যা নয়, তার চেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে নারী কর্মীদের নিয়ে। তাদের এক ধরনের কাজের কথা বলে অন্য কাজ করানো হয়। যেটা তারা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। অনেকে বিদেশে কাজের ধরন এবং কাজের সার্বিক চিত্র সম্পর্কে অবহিত কিংবা বেতনভাতার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সুরাহা না করে বিদেশ যায়। দেশে থাকা অবস্থায় বিদেশে গিয়ে একজন কর্মী কি কাজ করবে, তার বেতনভাতা, চিকিৎসা কিংবা ছুটি-ছাঁটার বিষয়টি গোপন রাখা হয়। দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্টরা তাদের সে ব্যপারে সম্যক্ষ ধারণা দেন না। সে কারণে বিদেশের মাটিতে পা রাখার পরই একজন বাংলাদেশি কর্মী বুঝতে পারে সে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছে। বিদেশ যাওয়ার পরপরই কাজ পাওয়া যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে নারী কর্মীদের নিয়ে সংকট বেশি। আমাদের দেশের নারীরা অন্য দেশে গিয়ে আত্মঘ্লানির মধ্যে জীবনযাপন করবে সেটা মেনে নেয়া যায় না। জনশক্তির ব্যবসার আড়ালে আদম ব্যাপারী, দালাল কিংবা মানব প্রাচারকারী যা-ই বলা হোক না কেন এই চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত ধুরন্ধর। তাদের মিষ্টি কথায় অভাব অনটনে থাকা মানুষ বিভ্রান্ত হয়। আর্থিক সংকট ঘুচিয়ে দেয়ার আড়ালে তাদের আর্থিক ও মানসিকভাবে সর্বনাশা পথে নিয়ে যায় এসব চক্র। মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্যারা নানা রকম প্রলোভন দেখায়। তাদের সত্য মিথ্যার সংমিশ্রণে মানুষ ভালো-মন্দ বিচার করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যাদের বিদেশে পাচার করা হয় এবং তারা বিদেশে গিয়েই বুঝতে পারে কতটা ফাঁদে তারা পা দিয়েছে। নারী কর্মীদের অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কখনো কখনো অন্য কারো সহায়তায় ওই দেশের পুলিশ তাদের উদ্ধার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে আসার পর মামলা করলে আসামিকে গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষী পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে অবস্থান করা মানব পাচারকারীরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও সমাজে প্রভাবশালী হয়ে থাকে। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দীর্ঘদিন চালানো সম্ভব হয় না। আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হাওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। সাংসারিক অভাব-অনটন ও দৈন্যদশার সুযোগ নিয়ে বিশেষ করে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সাংসারিক কাজ করার বিনিময়ে অনেক অর্থ-কড়ির লোভ দেখানো হয়। বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাবের প্রলোভনে পড়ে অনেকে বিদেশ যেতে রাজি হয়। পাসপোর্ট ও মেডিকেলসহ অন্যান্য কাগজ তৈরির জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয় কোনো কোনো কর্মীকে। রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে অলিখিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর/টিপসই রেখে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে প্রতিশ্রুত কাজ না দিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দেশে ফেরার কথা বললে লাখ লাখ টাকার খরচ দাবি করা হয়। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে মানব পাচার অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। খালাস পাওয়া মামলার আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণের জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। অপরদিকে অব্যাহতির আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, বাদী ও আসামি পক্ষ দুজনই আদালতে এসে বলে মামলা চালাবেন না। আসামি অব্যাহতি পেলে বাদীর কোনো আপত্তি নেই। সবদিকে বিবেচনা করে আদালত আসামিদের মামলার দায় হতে খালাস বা অব্যাহতি প্রদান করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুসারে সারা দেশে ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৬৮৩টি মামলা। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট মামলা দাঁড়ায় ৭১৬টি। পূর্ববর্তী মামলাসহ অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ২৪৬টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১২৯টি মামলায়। আসামি করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০৯ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট ১৫ হাজার ১২৬ জনকে। খালাস দেওয়া হয় ১২৭৯ জন আসামিকে। সাজা দেওয়া হয় ৪ মামলার আসামিকে। বর্তমানে ৭৪৫টি মামলা তদন্তধীন। এদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি নতুন মামলা করা হয়। এদের মধ্যে ৫২টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাকি ৭৩টি মামলা তদন্তাধীন। মানব পাচার মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে সমন জারি করেন আদালত। সমন জারির পরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপরও সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হন না। মামলার বাদী ও সাক্ষীদের যে ঠিকানায় সমন পাঠানো হয় সে ঠিকানায় তাদের পাওয়া যায় না। সাক্ষী ছাড়া মামলা প্রমাণ করা যায় না। তাই অধিকাংশ মানব পাচার মামলার আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব পাচার মামলা আপসযোগ্য নয়। আসামিদের আপসের ভিত্তিতে খালাস দেওয়া হলে আইনগতভাবে শুদ্ধ হবে না। বেশিরভাগ মানব পাচার মামলার আসামি হয় প্রবাসী। তারা আপসের শর্তে জামিন নিয়ে আবার বিদেশ চলে যায়। তাই আসামিদের জামিন দেওয়ার সময় তাদের পাসপোর্ট জিম্মা রাখার শর্তে জামিন দেওয়া যেতে পারে। যাতে আসামিরা দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে যেতে না পারে। প্রবাসীরা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি। তাদের কল্যাণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে হবে।