ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পহেলা জানুয়ারি বই উৎসব অব্যাহত থাকুক অনন্তকাল

জিয়াউল হক
পহেলা জানুয়ারি বই উৎসব অব্যাহত থাকুক অনন্তকাল

দেশে হরেক রকমের উৎসব রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত তা পালিতও হচ্ছে। এসব উৎসবের ভিড়ে বর্তমান সরকার বাঙালি জাতিকে একটি ব্যতিক্রমী উৎসব উপহার দিয়েছেন। তা হচ্ছে ‘বই উৎসব’ বা ‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব’। জাতিকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতেই শেখ হাসিনার এমন উদ্যোগ। বর্তমান বিশ্বে তার এই উদ্যোগ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিগত ১৪ বছর ধরে বই উৎসবের ব্যানারে ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দিচ্ছেন। এটি বাঙালি জাতির জন্য নেহাৎই কম পাওয়া নয়।

শিক্ষার সব শাখার প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে পাচ্ছেন সব পাঠ্যবই। যা একসময় অকল্পনীয় ছিল। বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের বই বই গন্ধ শুঁকছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এর চেয়ে আনন্দক্ষণ আর কি হতে পারে? মহা এই কর্মযজ্ঞের একক কৃতিত্ব বর্তমান সরকার ও সরকার প্রধান দেশরত্ন শেখ হাসিনার। তিনিই বিশ্বে প্রথম। তার আগে বিশ্বের কোনো সরকার বা রাষ্ট্র প্রধানই এমন স্বদিচ্ছা পোষণ করেনি। অর্থের মাপকাঠিতে আমরা যাদের উন্নত রাষ্ট্র বলে জ্ঞান করি এমন কি তারাও পারেনি। যা বাংলাদেশ পেরেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পেরেছে।

এহেন কৃতিত্বের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাধুবাদ পেতেই পারেন। এই বই উৎসবের ফলে সরকার অন্তত দেশের সব নাগরিককে একটা বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে, তা হলো- সবারই রয়েছে শিক্ষা প্রাপ্তির সমঅধিকার। অর্থাভাবে বই কিনতে না পাওয়া কিংবা সঠিক সময়ে বই হাতে না পাওয়া, বেদনার্ত মুখগুলো আর দেখতে হচ্ছে না।

এটাই বা কম কিসে! বই উৎসব শুরুর আগে এধরনের বেদনার সংবাদ প্রতিনিয়ত পড়তে হতো। এখন আর এসব মন খারাপ করা সংবাদ পড়তে হয় না। জোড়াতালি দেওয়া ছেঁড়া ফাটা পুরাতন বইও খুঁজতে হয় না।‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ এই স্লোগান নিয়ে ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে বই উৎসব। যা অদ্যবধি অব্যাহত রয়েছে। করোনাকালের দুঃসময় বাদে এই ধারা অব্যাহত আছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দিন বদলের সনদ ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসে।

নির্বাচনি অঙ্গীকার থেকেই মূলত এমন সিদ্ধান্ত। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেওয়া। বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যারা অনুঘটক হয়ে ইতিহাসের সোনালি পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন এরইমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছে।

নির্বাচনের ডামাডোলে বই উৎসব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই সংশয় উবে দিয়ে বই উৎসব করার অনুমতি দিয়েছে। তবে কিছু শর্তজুড়ে দিয়েছে। বিগত বই উৎসবে জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতে পারলেও এবার পারছেন না।

গতকাল প্রধানমন্ত্রী সীমিত পরিসরে বই উৎসবের শুভ উদ্বোধন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের বরাতে জানা যায়, পহেলা জানুয়ারি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ স্ব স্ব কর্মস্থলে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণের সঙ্গে বই উৎসব পালন করবেন। নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতেই নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্ত।

নতুন কারিকুলাম যুক্ত হওয়ায় অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই ছাপতে বিলম্ব হয়েছে বলে জানা যায়। এই দুই শ্রেণির বাদে বাকি সব শ্রেণির বই এরইমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছেছে। এনসিটিবি জানায়, সিলেবাস পরিবর্তনের ফলে অষ্টম ও নবম শ্রেণির পান্ডুলিপি হাতে পেতে বিলম্ব হওয়ায় সাময়িক এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বই পৌঁছে যাবে এবং দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই বছর প্রাক-প্রাথমিক হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি বইয়ের চাহিদা রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকে ৩০ লাখ ৮০ হাজার ২০৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮টি বই, প্রাথমিক স্তরে প্রথম শ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১ কোটি ৮২ লাখ ৫৫ হাজার ২৮৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৮ কোটি ৭৪ লাখ ৪ হাজার ৬৯৭টি বই, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষার ৮৫ হাজার ৭ শত ২২ জন শিক্ষার্থীর জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ৩১টি বই, ইবতেদায়ি প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৭৬টি বই, মাধ্যমিক স্তরে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ১ কোটি ৪ লাখ ৯০ হাজার ১০৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৩ কোটি ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৬৭টি বই, দাখিলও মাধ্যমিকের অনুরুপ ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৪ কোটি ১৪ লাখ ৪৭ হাজার, ৬৪২টি বই, ইংরেজি ভার্সনও একই ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১১ লাখ ৭২ হাজার ৫৭টি বই, কারিগরি ট্রেড বই ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৫২ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার ২৯২টি বই, এসএসসি ভোকেশনাল ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৩৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭০২টি বই, দাখিল ভোকেশনাল ৬ হাজার ১৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৭৯ হাজার ২৯৫টি বই, ব্রেইল পদ্ধতির ৭২৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৫ হাজার ৭ শত ৫২টি বই এবং শিক্ষক সহায়িকা রয়েছে ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৮টি। সর্বমোট ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি বই বিনামূল্যে সরবরাহ করবে সরকার। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হলে সবকিছুই পরিবর্তন হয়। পরিবর্তিত সরকারের মর্জি মতো আগের সবই ছেঁটে ফেলেন।

এখনো অবশ্য সেই আশঙ্কা তৈরি হয়নি। ভবিষ্যতে কি হবে তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তারপরও কথাচ্ছলে বলে রাখা ভালো। কারণ এর আগে এমন অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও বন্ধ হয়ে যাওয়ার নোংরা নজির দেশে রয়েছে।

পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় বিষয়টি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাঙালি যেহেতু অপরাজেয়। যে জাতি মহান স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ তাজাপ্রাণ ও ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম উৎসর্গ করতে পারে, সে জাতি কখনো মাথা নোয়াবে না।

বুকের পাঁজর দিয়ে হলেও টিকে রাখবে বাঙালির প্রাণের উৎসব, বই উৎসব। বই উৎসব দীর্ঘমেয়াদি হোক।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত