খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) সমাজ ও মানব জাতির কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন

তরিকুল ইসলাম

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানব জাতির কল্যাণের আলোকবর্তিকা নিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এই ধুলির ধরণীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক, সমাজ সংস্কারক, আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ ও দার্শনিক, দেশবরেণ্য সমাজসেবক, সবর্জন শ্রদ্ধেয় ছুফী সাধক, সাহিত্য সাধক এবং জননন্দিত জ্ঞান তাপস হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)।

তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমানদের অহংকার এবং সমকালীন আলোকিত মানুষ। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ছিলেন একজন অপূর্ব বিনয়ী মানুষ। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমেই আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। শিক্ষা সংস্কার ও সম্প্রসারণ, সমাজ উন্নয়ন, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে যে অবদান রেখেছেন তার জন্য আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) তাঁর সমগ্র চিন্তা-ভাবনার মধ্যদিয়ে একটি আলোকিত সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর সমাজ চিন্তায় মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’। স্রষ্টার এবাদত করতে হলে আগে সৃষ্টের সেবা করতে হবে। তিনি ভয়, শ্রদ্ধা এবং প্রেম এই তিনটার সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার কথা বলেছেন। মুর্শিদ মাওলার সেই জ্যোতির্ময় আলোকিত পথে হেঁটে খোদা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ছিলেন অনন্য। তার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মানুষ সেবা পাচ্ছে। আহ্ছানউল্লাকে মুখে নয় বুকে ধারণ করতে হবে। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা আমাদের যুগের কোনো মানুষের সঙ্গে তুলনীয় না। তিনি একজন সূফী। তার গুণাবলি গ্রহণ করতে পারলে আমরা হতে পারব সৎ ও সুখী’।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক, সমাজহিতৌষি ও তিনি একজন উচ্চ মার্গের আউলিয়া ছিলেন। বাংলার মুসলমানদের ইসলামিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে অবকাঠোমো উন্নয়নে তিনি ব্রতী হন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ছিলেন একজন লেখক ও সাহিত্যিক। তিনি অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষিত করতে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের হোস্টেল, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সবসময় উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষা প্রসার করেছিলেন।

তাঁর লেখার মধ্যেও সমাজ চিন্তা ও শিক্ষার উন্নয়নের কথা ফুটে উঠেছে। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ছিলেন একজন মিশনারি মনের মানুষ, স্বল্পভাষী এবং নীরব কর্মী। নীরবে কাজ করে একটি পশ্চাদমুখী জরাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জীবনে কীভাবে বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনা যায়, তাঁর এক উজ্জ্বল এবং অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তিনি। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবনধারা’ মলূত তাঁর কমর্কাণ্ডের বিবৃতি নয়, বরং সৃজনশীল এক কর্মসাধকের জীবনালেখ্য। ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’ এই দর্শনের ভিত্তিতে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর সমাজ ভাবনার বিকাশ ও বাস্তবায়ন। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, আর সেই মানুষের সার্বিক কল্যাণ তথা মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধনে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা ছিল তাঁর জীবনসাধনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মিশনের যাবতীয় মানব কল্যাণমলূক কার্যক্রমের মধ্যে অধ্যাত্ম সাধনার একটি যোগসূত্র নির্মাণ করাই হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল। আহ্ছানিয়া মিশনকে তাই পবিত্র, সত্যনিষ্ঠ ও অধ্যাত্মবোধক হিসাবে চিহ্নিত করার মধ্যে তাঁর জীবন দর্শনকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের জন্য হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) আজীবন কর্মসাধনা করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তার যে শতাধিক মূল্যবান গ্রন্থ সেখানে তাঁর শুদ্ধাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার মতে রুচি মার্জিত করাই সাহিত্যের কাজ, রুচি কলুষিত করা নয়। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত। তিনি একাধারে ছিলেন পূর্ণ ধার্মিক আবার পূর্ণ আধুনিক। আধুনিকতা আর ধার্মিকতার সমন্বয় ঘটিয়ে তিন যে দর্শনের কথা বলে গেছেন তা কল্যাণের দর্শন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার ধর্মীয় জীবন ও মূল্যবোধের ভিত্তি হলো শিক্ষাবিদ হিসেবে কর্মব্যস্ত জীবন যাপন। তিনি কামেল ঈমান, সাচ্চা একিন, কোশাদা রিজিক কামনা করতেন, বাস্তব জীবনে তা অর্জনে ছিলেন নিবেদিত নিষ্ঠাবান। তার ধর্মীয় ব্যাখ্যা স্বচ্ছ ও চমৎকার। তিনি প্রেমময়ের সঙ্গে নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিতেন। ধর্মের নামে লেশমাত্র ভন্ডামি ছিল না তার মধ্যে। আমিত্বকে বিনাশ কষ্টকর জেনেও তা অর্জনে তার সাধনা ছিল অক্লান্ত, অফুরন্ত অপার। তিনি শিক্ষাকে মুক্তির পথ বা পন্থা হিসেবে জ্ঞান করেছেন। তিনি বৈরাগ্য সাধনে নয়, কর্মে ব্যাপৃত হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। জীবনসাধনায় স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে এখানে তার সবিশেষ সমিল পরিলক্ষিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর জীবন ছিল একজন পরিপূর্ণ মানুষের জীবন। আর সে জীবনের মূল রহস্য ছিল মানব সেবায় ব্রতী হওয়া। তিনি ছিলেন সবর্জন স্বীকৃত একজন যগুশ্রেষ্ঠ মানুষ; সমাজ ও মানব জাতির কল্যাণ কামনায় মগ্ন ছিলেন তিনি। আমরা তাঁকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবো অন্তকাল পর্যন্ত। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক ও সাধক পুরুষ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এঁর মানবসেবার পরিধি ও কাঠামোর অর্থবহ বা বাস্তবায়ন ঘটেছে মানব কল্যাণে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে।

সাতক্ষীরার নলতায় ওলিকুল শিরোমণি মুর্শিদ মাওলা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বহুমুখী কর্মময় একজন মানুষ ছিলেন। তবে তিনি মূলত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করে, শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করে, দেশে-বিদেশে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করে, শিক্ষার বিস্তার ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে তিনি যেমন নিজে আলোকিত-সুরভীত-সুশোভিত হয়েছেন, তেমনি এই শিক্ষাব্যবস্থার জ্যোতির্ময় আলোয় এই সমাজ ও দেশকে তিনি আলোকিত করেছেন। যে সুরভিত সৌরভ ও আলোকচ্ছটা এ বিশ্বের বুকে অনন্তকাল বহমান। লেখক : সংবাদকর্মী