ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইতিহাসের মহানায়ক : একটি অনন্য প্রকাশনা

মো. তাঈদ উদ্দিন খান
ইতিহাসের মহানায়ক : একটি অনন্য প্রকাশনা

বেশ দেরিতেই বইটি হাতে এলো। ২০২১ সালের প্রকাশনা। প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। ২০২০ সাল অর্থাৎ ‘মুজিববর্ষ’ থেকে দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশনা বের করার যে শোরগোল উঠেছিল- এরই ধারাবাহিকতায় ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। প্রকাশনাটি একদিকে যেমন আকর্ষণীয়, অন্যদিকে সংকলিত লেখাগুলোও হৃদয়গ্রাহী। বাজার দখল করা হাজারো অপ্রয়োজনীয় লেখার ভিড়ে এটি একটি অনন্য গ্রন্থ। সংকলনটির সম্পাদনা পরিষদে আছেন বর্তমান বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, মো. মনিরুজ্জামান, ইমতিয়াজ ফারুক, বাকির উদ্দিন ভূইয়া, মো. হুমায়ুন কবির এবং মোহাম্মদ মশিউর রহমান। তারা সবাই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সে-সময়ের নেতৃবৃন্দ এবং খ্যাতনামা আইনজীবী। আমাদের সবারই একটি আক্ষেপ থেকে যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতটুকু কাজ হচ্ছে, তা গোছানো নয় এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ কাজে খুব আগ্রহভরে এগিয়ে আসেনি। যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ স্থাপন করা হয়েছে, ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। এমনকি দেশে বহু স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে। একবার একটি অনুষ্ঠানে জনৈক আলোচক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধুই সেতু, ছাত্রাবাস, সড়ক, ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছেন। কিন্তু এসব ছাপিয়ে তিনি তো পুরো বাংলাদেশ। এ দেশের প্রতিটি ইঞ্চির প্রতিটি ধূলিকণার মাঝে তিনি মিশে আছেন।’ এটিই আসল বঙ্গবন্ধু। তার প্রকৃত পরিচয়। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের মূল্যায়ন প্রকৃতরূপে আজও হয়নি। যেমন হয়নি বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবন ও কর্মধারা, তার দর্শন, মতবাদ, দেশ শাসন নিয়ে কোনো বিশদ বিশ্লেষণ বা গবেষণা। তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির রাজনৈতিক অধ্যায় নিয়ে বহু সমালোচনা হলেও এর অর্থনৈতিক, সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে ন্যূনতম আলোচনা বা সমালোচনা কোনোটাই হয়নি। তার এই দর্শন অনালোচিতই রয়ে গেল। তার সহকর্মী, অনুসারী- কেউই এ বিষয়ে আলোকপাত করতে দ্রষ্টব্য পর্যায়ে এগিয়ে আসেননি। বরং বিরুদ্ধবাদীদের সমালোচনার শিকার হতে পারেন- এই ভয়ে নীরবই রয়ে গেছেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে কোনো গুরুত্ববহ গবেষণা হয়নি। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে বাজারে অনেক অনেক বই পাওয়া যায়। অধিকাংশ লেখকই অজ্ঞাতকুলশীল। অনেক বই স্পর্শ করার মতো নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য সেসব লেখায় বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তা চর্বিত চর্বণ। সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ কিছুই নেই। এক বই থেকে যেন শত বই লেখা হয়েছে। সাল, তারিখ, কর্মসূচি অভ্রান্ত নয়। অনেক বই পাঠে মনে হয়েছে, এগুলো বাতিল করা উচিত। যারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহচর, তারা স্মৃতিচারণ লিখতেও এগিয়ে আসেননি। তার হাতে গড়া রাজনীতিকরাও এক্ষেত্রে কৃপণতাই দেখিয়ে এসেছেন। যদি লিখতেন তারা, তবে বঙ্গবন্ধু ও সমকালীন ইতিহাসের অনেক তথ্যই পাওয়া যেত। আর তা যায়নি বলেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অহেতুক মিথ্যাচার বেশি হয়েছে। অপ-প্রচারের শিকার হয়েছেন তিনি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন আলোকিত মানুষ হিসেবে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে। আলোকিত এবং শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতে ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ স্মারকগ্রন্থটি প্রত্যেকের পাঠ করা উচিত। এতে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর অপর কন্যা শেখ রেহানা। আরো লিখেছেন দেশ সেরা আইনবিদগণ। লিখেছেন কয়েকজন সুপরিচিত বিচারপতি। এ ছাড়া দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীর লেখা এতে সংকলিত হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে জাতির পিতার জীবন ও কর্ম সত্যিকারভাবে মহিমান্বিত হয়েছে। তার সম্পর্কে আগামীতে যারা ধ্রুপদী গবেষণা করবেন তাদের জন্য লেখাগুলো বেশ কাজে আসবে।

এই স্মারকগ্রন্থে আরো যারা লিখেছেন- বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মো. নূরুল ইসলাম সুজন এমপি, শ ম রেজাউল করিম এমপি, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, মো. মাহবুব আলী এমপি, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, আবদুল বাসেত মজুমদার, সৈয়দ রেজাউর রহমান, ড. হারুণ-অর-রশীদ, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, আআমস আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, হারুন হাবিব, কাশেম হুমায়ূন, মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম, মো. মনিরুজ্জামান, ইমতিয়াজ ফারুক, মোহাম্মদ বাকির উদ্দিন ভূইয়া, মো. হুমায়ূন কবির এবং মোহাম্মদ মশিউর রহমান। এর বাইরে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত বেশকিছু অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে, যা পাঠকের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। যেমন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গণের বিশিষ্ট নাগরিকগণ কী মন্তব্য করেছেন, সে সম্পর্কে একটি অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিরচিত বইগুলোরও পরিচিতি আছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কেও একটি অধ্যায় আছে। মূল নিবন্ধের বাইরে ১৩০ পৃষ্ঠা এরকম দুর্লভ আলোচনায় ভরপুর। এ কারণেই বইটি একই সময়ে প্রকাশিত অন্যসব প্রকাশনার চেয়ে আলাদা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- জাতির পিতার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ সন্নিবেশ। উন্নত কাগজে ছাপা হওয়ায় নিঃসন্দেহে ছবিগুলো হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। এই স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। সহস্র সস্তা গ্রন্থের ভিড়ে একটি মননশীল গ্রন্থ যুগের আশা মিটিয়ে থাকে। এটি তেমনই একটি প্রকাশনা। তবে গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। এটি খুব সহজলভ্য কোনো গ্রন্থ নয়। যদিও প্রকাশনা তত্ত্বাবধান করেছে পাঠক সমাবেশের মতো খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান। গ্রন্থটির কোনো মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়নি। কোনো আগ্রহী পাঠক ইচ্ছে করলেই বইটির সন্ধান পাবেন না। শুধু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের পক্ষেই বইটি সংগ্রহ করা সম্ভব। আশা করি পরবর্তী সময়ে সংস্করণে গ্রন্থের এইসব সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে এটিকে আরো সর্বজনীন এবং সহজলভ্য করতে সচেষ্ট হবেন সম্মানিত সম্পাদনা পরিষদের সদস্যরা। ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ স্মারকগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন দেশের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। তিনি বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সাবেক ব্যাংকার এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ দায়েরকারী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত