ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন বছরে বাড়তি বাসাভাড়া

বাস্তবায়ন নেই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের
নতুন বছরে বাড়তি বাসাভাড়া

প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে বাসাভাড়া বাড়ানো হয়। বাসাভাড়া বাড়ানো নিয়ে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যকার বিরোধ নতুন নয়। বাড়ির মালিকের সাফ কথা বাড়তি ভাড়ায় থাকতে চাইলে থাকেন আর না থাকতে চাইলে বাড়ি ছেড়ে দেন। দুই কোটিরও বেশি মানুষের এ শহরে বছরের শুরুতে বাসাভাড়া বাড়ানো যেন অবধারিত। দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ রয়েছে। অথচ সেটি নিয়ে নেই কোনো প্রচার। ভাড়াটিয়া বা বাড়িওয়ালা কারও মধ্যেই নেই কোনো সচেতনতা। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রয়োগও অনেকটা শূন্য। নতুন বছরে রাজধানীর এলাকাভেদে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন বাসার মালিকরা। জানুয়ারি থেকেই পরিশোধ করতে হয় বাড়তি ভাড়া। এরসঙ্গে প্রতি বছরই ক্রমবর্ধমান গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল তো আছেই। এ নিয়ে মালিক-ভাড়াটিয়ার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে এই সমস্যা সমাধানের পথও দিন দিন রুদ্ধ হয়ে আসছে। মালিকদের অভিযোগ, ব্যয় বাড়ছে তাদের। সে কারণে বাধ্য হচ্ছেন ভাড়া বাড়ানোর। ভাড়াটিয়া পরিষদ বলছে, দেশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ‘মানবিকতার’ পরিচয় দেওয়া উচিত বাসার মালিকদের। তাদের আরও মানবিক হওয়ার পরামর্শ পরিষদের। মালিক বাসার কিছু সংস্কার করার অজুহাতে ভাড়া বাড়ালেও সংস্কার করতে অনেক বিলম্ব করে। কখনো কখনো করে নানা টালবাহানা। নিত্যপণ্যের দামও নাগালের বাইরে। তার ওপর বাড়তি বাসা ভাড়া। বাড়ির মালিকরা সমিতি করেন। তাদের নিজস্ব একটা কমিটি রয়েছে। এই কমিটির নেতারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। অথচ ভাড়াটিয়ারা কেউ কাউকে জানেন না, চেনেন না। কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ নেই। একই ভবনে বাসবাস করার পরও সাধারণত কেউ কারো বাসায় যাতায়াত করেন না। কোনো ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কোনো বাসার মালিক অন্যায় আচরণ করলে প্রতিবাদ করার মতো সুযোগ ভাড়াটিয়াদের থাকে না। যে কোনো বিরোধে বাড়ির মালিকরা এক এবং ঐক্যবদ্ধ। তারা সমন্বিতভাবে ভাড়াটিয়াকে মোকাবিলা করে। বাসার মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি তুলে ধরছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- বাড়ি সংস্কারের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন সংস্কার করার কাজে বাড়তি টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তারাও সংকটে রয়েছেন। নিয়মনীতি ছাড়া যখন-তখন খেয়ালখুশিমতো ভাড়া বৃদ্ধি হচ্ছে এমনকি নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার অপেক্ষা পর্যন্ত না করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ভাড়ার পরিমাণ অযৌক্তিক হারে বাড়ে প্রতিনিয়ত। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্যমতে, রাজধানীর ৮৩ শতাংশ বাসিন্দাই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আর প্রতিবছর তাদের দিতে হচ্ছে বর্ধিত ভাড়া। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন এনে ১৯৬৪ সালের বাড়িভাড়া বিধিমালা অনুসরণ করেই ১৯৮৬ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করে সরকার, যার মেয়াদ ছিল মাত্র তিন বছর। বর্তমানে ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ৩ নম্বর আইন নামে পরিচিত যে আইনের বিধিবিধান যেমন কোনো বাড়িওয়ালা মানেন না, তেমনি ভাড়াটিয়ারাও জানেন না এর বিধানই বা কী? এই আইন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বাড়িভাড়ার নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা। যে নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই এবং কোনো মনিটরিংয়েরও ব্যবস্থা নেই। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থরক্ষা করার চেষ্টা কেউ করে না। বাড়িভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকরা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) নীতিমালা উপেক্ষা করে ইচ্ছামাফিক নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়িভাড়া আদায় করছেন বছরের পর বছর। যার দায় পোহাতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে। প্রতিকারের কোনো পদক্ষেপ নেই ডিসিসির। সিটি কর্পোরেশনের আওতায় শহরকে ১০টি জোনে ভাগ করে বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে তিন স্তরের বাড়িভাড়া নির্ধারণ করেছে সেগুলো হচ্ছে মূল রাস্তার (মেইন রোড) পাশে, গলির ৩০০ ফুটের মধ্যে এবং গলির ৩০০ ফুটের বাইরে। বাড়ির ক্ষেত্রেও তিনটি স্তর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: পাকা, সেমিপাকা ও কাঁচা বাড়ি। ভাড়া পরিশোধের কোনো রশিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে ভাড়াটিয়াকে দেয়া হয় না। বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে সাধারণত উচ্ছেদ মামলা, নিষেধাজ্ঞা মামলা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি মামলা করে থাকে। এসব মামলা করতেও হয়রানির শিকার হতে হয় ভাড়াটিয়াদের। বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে মামলাগুলো। সিটি কর্পোরেশন তাদের দায়িত্ব পালন করলে ভাড়াটিয়াদের হয়রানি কম হতো বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটে দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হলো, আইনসম্মত কোনো চুক্তিপত্র না থাকা। আবার অনেক বাড়ির মালিক বেশি সুবিধা নেওয়ার জন্য লিখিত চুক্তিই করেন না। অনেক সময় দেখা যায় উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তিপত্র থাকলেও তা হয় ত্রুটিপূর্ণ যা আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাদের ধারণা, লিখিত চুক্তি না থাকলে ভাড়াটেকে অনেক সহজে উচ্ছেদ করা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, বাড়ির মালিক ভাড়াটেকে উচ্ছেদের জন্য জরুরি সেবা- বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অমানবিক। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না। এছাড়া বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে এর অধীনে বিধি প্রণয়নের বিধান থাকলেও তার কোনো কার্যকারিতা নেই। অনেক সময় কোনো কোনো সংগঠন বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করার জন্য রিট পিটিশন দায়ের করে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই হয় না আইনি বিলম্বের কারণে। ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত মানুষ দিন দিন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাড়িভাড়া আইন না মানার শাস্তির বিধান করা না হলে এ সমস্যা জটিলতায় রূপ নেবে। এ কারণে ফৌজদারি আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নির্যাতনকারী বাড়িওয়ালাদের ফৌজদারি আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে ভাড়াটিয়ারা উপকৃত হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত