সুস্থ সামাজিক আচরণের বিকাশে পরিবারের ভূমিকা

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একান্নবর্তী পরিবারব্যবস্থা বলতে মূলত আমাদের প্রাচীন সমাজব্যবস্থাকে বোঝায়। যেখানে মা-বাবা, সন্তান, দাদা-দাদিসহ পরিবারের সবাই একত্রে শান্তিতে বসবাস করত। সমাজব্যবস্থা মূলত হাজার বছর ধরে চলে আসা সংস্কৃতি এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে সেই আদিকাল থেকেই একান্নবর্তী সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সে সময়গুলোতে সমাজের শৃঙ্খলা শুরু হতো পরিবার থেকেই। পরিবারব্যবস্থা সামাজিকব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। পরিবারে যে মানুষটি সবচেয়ে বয়স্ক তার কথা সবাই মেনে চলত। এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়ির বড়দের কথা সবাই মেনে চলত। পরিবারের মধ্যেই একটি চেইন অব কমান্ড ছিল। সে কারণে সমাজেরও চেইন অব কমান্ড ছিল। বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যের মতো একান্নবর্তী পরিবারও আজ হারিয়ে গেছে। আজকের সমাজের সাথে তখনকার সমাজের ব্যাপক পার্থক্য। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আজ অবধি সেই পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটার সাথে সাথে জীবনযাত্রার মান এবং ধরনে পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিকব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটার জন্য আমাদের সার্বিক জীবনযাত্রারও পরিবর্তন ঘটেছে। আজ যেমন সমাজে প্রবীণদের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে। সে সময় এর ঠিক উল্টোটা ছিল। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির ইর্ষাবোধ সমাজের প্রতিটি স্তরে লক্ষ্যণীয়। চাষের জমি যেমন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। একান্নবর্তী পরিবারে কি সুবিধা ছিল বা আজ একান্নবর্তী পরিবার না থাকায় কি অসুবিধা হচ্ছে তা অনুধাবন করতে হলে আজকের হিংসা, ক্রোধ আর লোভাচ্ছন্ন সমাজের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতা প্রতিটি পরিবারকে গ্রাস করেছে। কমে যাচ্ছে পরিবারের এক সদস্যের প্রতি আরেক সদস্যের দায়িত্ববোধ। একই পরিবারের সদস্য হয়েও সদস্যদের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের দূরত্ব। মা-বাবার সাথে সন্তানের দূরত্ব এতটাই বাড়ছে যে তা সন্তানের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আজ অধিকাংশ পরিবারেই মা-বাবা দুজনকেই কর্মব্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে।

সারা দিন শেষে বাসায় ফিরে সন্তানকে কাছে টেনে নেয়ার সময়টুকু পাওয়া যায় না। মা-বাবার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে সন্তান ঝুঁকছে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর। সারাক্ষণ মোবাইল ট্যাবের স্ত্রিনে চোখ রাখা এ যুগের ছেলে-মেয়েদের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এরা পাচ্ছে আনন্দহীন একটি জীবন। এ বিষয়ে কবিগুরুর মত হলো, ‘ক্ষুধার কারণে কেউ মরে না কিন্তু আনন্দের অভাবে মানুষ মরতে পারে। সেই মৃত্যু মানসিক। যা শরীরের মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর। আজকের সন্তানদের বিচ্ছিন্নতার এই বিষয়টিই একাকিত্ব। বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায় দেশের তরুণদের অনেকেই হতাশাগ্রস্ততায় ভুগছে। এর কারণ মানুষের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে। যন্ত্রের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে একসময় নিঃসঙ্গতা গ্রাস করছে। সেই নিঃসঙ্গতা থেকেই হতাশা নামক অবস্থা মনে প্রভাব ফেলছে। পত্রিকার পাতা খুললে মাঝে মাঝেই তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। এই আত্মহত্যার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আত্মহত্যার কারণ এতটা তুচ্ছ যে, ভাবলেই বেশ অবাক হতে হয়। মোবাইল বা বাইক না কিনে দেয়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার মতো অতি তুচ্ছ কারণেও অতি মূল্যবান একটি প্রাণ বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হচ্ছে না। পরিবারের এই বিচ্ছিন্নতার ফলস্বরূপ প্রবীণরা হয়ে গেছে প্রচণ্ডভাবে একা এবং অসহায়। তাদের জগত আজ ছোট। সমাজে প্রবীণ সদস্যদের প্রতি যেন কারও কর্তব্য নেই। একসময় পাড়ার দোকানে প্রবীণ কাউকে দেখলে কিশোররা দূরে সরে যেত। আজ সেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন কিশোরের দল দেখলেই প্রবীণরা অন্য পথে হাঁটে। অনেক কিছু দেখলেও না দেখার ভান করে চলে যায়। এভাবেই সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সময়ের ফাঁদে পড়ে আর বৃদ্ধ মা-বাবা তো সেখানে বোঝা হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের অনেকের শেষ জীবন সেখানেই পার হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আজ ঘরে ঘরে টেলিভিশন। ঘরে ঘরে বললে ভুল বলা হয়। বলতে হয় প্রতিটি কক্ষে। অথচ মাত্র এক দশক আগেও এ দৃশ্য কমই দেখা যেত। বিশ বছর আগেও সারা পাড়া ঘুরলে এক বা দুই বাড়িতে টেলিভিশন দেখা যেত। পাড়ার সব মানুষ জড়ো হতো সেই টেলিভিশনওয়ালা বাড়িতে। ফলে একজন অন্যজনের খবরাখবর সহজেই পেত। বিকাল হলেই বাইরে খোলা স্থানে জড়ো হয়ে একজন অন্যজনের খোঁজ নিত। কিন্তু সমাজে আজ অনেক পরিবর্তন। আজ একজন অন্যজনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। পরিবার থেকে পরিবারের বিচ্ছিন্নতা, পরিবারের সদস্য থেকে অন্য সদস্যের বিচ্ছিন্নতা সামাজিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে। একান্নবর্তী পরিবার আমাদের বাঙালিদের কৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সময়ের পরিক্রমায় পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।